Thursday, August 30, 2012

এসব কুলাঙ্গার সন্তানের জন্যই মনে হয় জাহান্নাম! বৃদ্ধাশ্রমে চোখের জলে কাটছে স্বজনহারাদের রোজার মাস


  লিখেছেন হাসান ১৬ অগাস্ট ২০১২, সকাল ১০:০৮
















অনেকে গভীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকেন, হয়তো এখনি সন্তান এসে আব্বা আম্মা বলে ডাকবে- প্রতিদিন ঐ সময় এই স্মৃতি বুকে ধরে শুধু চোখের পানি ছাড়েন। আসলে কেউ আসবে না। চোখের জলেই হবে তাদের চির বিদায় বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। 
















চোখের পানি আটকাতে পারলামনা! অন্যরকম কষ্টকর ও ভাবনার একটি চিত্র- বৃদ্ধাশ্রমে চোখের জলে কাটে স্বজনহারাদের রোজার মাস- চার বৃদ্ধার মৃত্যু, দাফনেও আসল না আপনরা- আমরাও কি পাশ্চাত্যের অমানবিক জীবনের দিকে? 


"মা কথাটি ছোট্ট অতি, কিন্তু জেনো ভাই
ইহার চেয়ে নাম যে মধুর, ত্রিভূবনে নাই।"
কাজী কাদের নেওয়াজ 
















সন্তান, আপনজন ও আত্মীয়-স্বজনহারা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পুরো রমজান মাস কাটলো চোখের জলে। কেউ কেউ ভুলতে পারেননি তাদের পুরানো স্মৃতি। স্ত্রী, স্বামী, সন্তান ও নাতী-নাতনীদের নিয়ে রমজান মাসে এক সঙ্গে ঘরে বসে ইফতার করতেন। এতে কতই আনন্দ উপভোগ করতেন। কয়েকজন বৃদ্ধ বলেন, চাকরি কিংবা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকলে ইফতারের সময় ঘনিয়ে এলে স্ত্রী ও সন্তানদের কথা মনে পড়ে যায়। কখন তাদের সঙ্গে একত্রে ইফতার করবেন। তখন চাকরি কিংবা ব্যবসায়ের কাজ রেখে অথবা দ্রুত শেষ করে বাড়ি ফিরে যান। এমন কি স্ত্রী ও সন্তানরা পিতা কখন আসবে? ইফতারি প্রস্তুত করে বসে থাকতো। কোন কারণে ইফতারিতে অংশগ্রহণ করতে না পারলে ঐ দিন বাসায় আপনজনদের ইফতার ঠিকমত হতো না। কিন্তু বয়সের ভারে পরিবারের সবার প্রিয় ব্যক্তি এক সময় আয়-উপার্জন করতে অক্ষম হওয়ায় সবার বোঝা হয়ে যান। বৃদ্ধের প্রতি মানসিক ও শারীরিকসহ কতই নির্যাতন নেমে আসে। অবশেষে নাড়ি ছেড়া ধন ও কলিজার টুকরা সন্তানদের দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা পিতা-মাতা সইতে পারেননি। চোখের পানি মুছতে মুছতে বাড়ি থেকে পাড়ি দেন অচেনা পথে। অবশেষে ঠাঁই নেন হূদয়বান ব্যক্তি ও শিল্পপতি খতীব আব্দুল জাহিদ মুকুলের প্রতিষ্ঠিত গাজীপুর মনিপুরের বিশিয়া কুড়িবাড়ি বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। মাদারীপুরের মতিজান (৭৪), নারায়ণগঞ্জের নাসিমা বেগম (৮০), বীর মুক্তিযোদ্ধা কুলসুম বিবি (৮১), ময়মনসিংহের ওসমান গনি (৭০), গফরগাঁও-এর আব্দুল খালেক (৭০), পিডব্লিউডির সাবেক হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম (১০৫) এ সব কথা বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

বৃদ্ধাশ্রমে পহেলা রমজানে ইফতারের সময় তাদের সেই স্মৃতি মনে পড়ে। ঐ দিন অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ইফতারি হাতে নিয়ে কেঁদে ফেলেন। জীবনের শেষ সময় কলিজার টুকরা সন্তান কিংবা আপনজন দ্বারা বিতাড়িত হয়ে একাকী ইফতার করতে হবে, এটা তাদের কল্পনার বাইরে। অনেকে বলেন, এটা তাদের কপালের লিখন। প্রতিদিন রমজানে ইফতার ঘনিয়ে আসার ঘণ্টাখানেক আগে বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দায় সারিবদ্ধভাবে তারা একে অপরের পুরনো স্মৃতি নিয়ে গল্প করেন। অনেকে গভীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকেন, হয়তো এখনি সন্তান এসে আব্বা আম্মা বলে ডাকবে, আসেন ইফতারের সময় হয়েছে, এক সঙ্গে ইফতার করি। প্রতিদিন ঐ সময় এই স্মৃতি বুকে ধরে শুধু চোখের পানি ছাড়েন। আসলে কেউ আসবে না, চোখের জলেই হবে তাদের চির বিদায় বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন।

গত রমজানে চারজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মারা গেছেন। তাদের মধ্যে তিনজনের দাফন বৃদ্ধাশ্রমে হয়েছে। অপরজনের লাশ স্বজনরা নিয়ে যায়। তাও খবর দেয়ার পর স্বজনরা এসেছেন। যেভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বৃদ্ধাশ্রমে এসেছেন, লালশটি নিয়ে আপজনরা এর দায় মুক্ত হতে চেয়েছে বলে কয়েক বৃদ্ধ জানান। এ যেন, কাটা ঘায়ে লবণ দেয়ার মত কাজ বলেও কোন কোন বৃদ্ধ অভিমত ব্যক্ত করেন।

বৃদ্ধাশ্রমে ১৯০ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪০ জন বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গিয়ে রমজান মাস কাটিয়েছেন। বাকি ১৫০ জনের মধ্যে ৪৫ জন বৃদ্ধ ও ৫৫ জন বৃদ্ধা বৃদ্ধাশ্রমে রোজা রেখেছিলেন। ৫০ জন অসুস্থতার কারণে রোজা রাখতে পারেননি বলে বৃদ্ধাশ্রমের সুপার মোহাম্মদ শরীফ জানান।


তখনো শেষ বিকালের লালচে আলোর খেলা চলছে দিগন্তে। নতুন আরেকটি সন্ধ্যার আগমনী সংকেত বাজছে। কেন যেন পুরোনো মানুষদের কথা ভীষণ মনে পড়ছিলো। কিভাবেই যে টুপটাপ ঝড়ে গেছে চারপাশের প্রিয় মানুষগুলো। যে জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে রাস্তাটা কোথাও যেন হারিয়ে গেছে। রাস্তাও বোধ হয় পথ হারায় কখনো কখনো।

এই জায়গাটাতেই প্রায়ই দেখা হতো এক প্রবীণের সাথে। অশীতিপর এই মানুষটির সাথে আলাপও হতো বটে। এই ভদ্রলোকের হাঁটাটাকে সব সময়ই মনে হতো উদ্দেশ্যহীন, গন্তব্যহীন। আসলে এ রকম অনেক নুয়েপড়া কুঁজো হয়ে যাওয়া বৃদ্ধরা এখানে ওখানে ঘরছাড়া বালকের মত ঘুরে বেড়ায়।

বয়স ৬০-৬৫ পেরুলেই খুব ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশের শিতি-অশিতি সব শ্রেণীর মানুষেরা মনে করে পশ্চিমা দেশের তুলনায় আমরা আমাদের বাবা মাকে বেশি সম্মান করি, ভালবাসি। কিন্তু আমার কাছে তুলনা করার ব্যাপারটি খুব হাস্যস্পদ মনে হয়।

আমরা আমাদের প্রবীণ বাবা মায়ের ব্যক্তি স্বাধীনতার কতটা মূল্য দেই? আমাদের দেশের বেশীর ভাগ ছেলে মেয়ে; বাবা-মায়ের বয়স হয়ে গেলে মনে করি ওরা বুড়ো হয়েছে। ওদের আবার কি মতামত। ওরা তো সেকেলে। অনেকেতো নিজের কারণেই হোক কিংবা পরিস্থিতির কারণেই হোক বাবা-মাকে বোঝা মনে করে থাকে। এসব বাবা-মা এমন এক পরিস্থিতির শিকার হন যে পরিবার যদি তাদের না দেখে তাহলে তাদের দেখ-ভালের কেউ থাকে না। কারণ আমাদের সমাজে সামান্য হলেও একজন বৃদ্ধের মূল্য শুধু পরিবারের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে।

দেশপ্রেমের জোয়ারে এদেশের মানুষ শুধু ভাসতে শিখছে, মানুষের জীবনের দাম দিতে শিখেনি। একজন বৃদ্ধ লোকের প্রতি কোন রকমের সহানুভূতি আমরা দেখাই না। অথচ পাশ্চাত্য দেশে বিভিন্ন স্তরের সরকারি সংস্থা থেকে পাওয়া যায় নানা রকম সুযোগ-সুবিধা। শুধু তাই নয় ডাক্তারের টাকা, হাসপাতালের টাকা, এমনকি ওষুধের টাকাও আসে সরকারি তহবিল থেকে। তারপর পয়ষট্টির পর থেকে বাসের ভাড়া, প্লেনের ভাড়া, ট্রেনের ভাড়া, কাপড় চোপড়ের দাম, জুতোর দাম সবকিছুতে ছাড় দেওয়া হয়। সময় সময় সরকার তাদের পৃথিবীর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখার জন্য ভ্রমনভাতাও দেয়। অথচ আমাদের দেশে এসবের বিন্দুমাত্র সুযোগ সুবিধা নেই একজন বৃদ্ধলোকের। সঙ্গত কারনেই বাবা-মাকে দেখার দায়িত্ব সন্তানের।

যেহেতু আমাদের
পারিবারিক বন্ধন হাজার বছরের লালিত ঐতিহ্য। সেহেতু এই বন্ধন অটুট রাখার জন্যেই বৃদ্ধ বাবা-মার সকল প্রকার দায়িত্ব সন্তানের। পাশ্চাত্যে কথা ভেবে আজকাল অনেকেই বাবা-মার দায়িত্ব নিতে অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। তারা মনে করে ব্যক্তি স্বাধীনতার মূল্য নিয়ে চলাফেরা যায়না। অথচ এই বাবা-মার সন্তান হিসাবে যখন আমরা বড় হয়ে উঠি তখন কোনো বাবা মা কি তার সন্তানকে বোঝা মনে করে ? ছেলে যে বড় হবে মস্ত বড় চাকরি করবে। আমাদের সব কষ্ট পুষিয়ে দেবে। এই ভালবাসার কতটুকু মূল্য ছেলে মেয়েরা দেয় ? খুব বেশী অধিকার সচেতনা আমাদের মন মানসিকতাকে হীন করে দিয়েছে। সুখ অন্বেষণে জীবনটাকে আমরা বারবার ওলট পালট করে দেখি ঠিক, কিন্তু কজন সুখী হতে পারছি?

পাশ্চাত্য দেশগুলোতেও বাবা মা
রা সস্তানকে যথেষ্ট যত্নে লালন পালন করে। সন্তানরাও তাদের বাবা মাকে অনেক বেশী ভালবাসে। তবে তাদের ক্ষেত্র ব্যতিক্রম এটুকুই যে, সেইসব বাবা মায়েরা নিজেদের জীবনকেই সব চেয়ে বেশী প্রাধান্য দেয়। যার ফলে তাদের পারিবারিক কোন বন্ধন থাকে না।

কিন্তু আমাদের বাবা মারা তো সন্তানের জন্যেই সব কিছু করে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এমন কোন বাবা মা কি আছে যারা সন্তানের জন্য নিজেদের সুখ, স্বাচ্ছন্দ বিসর্জন দেননি। যে বাবা মা জীবনের ধন ভেবে সন্তান সংসার আঁকড়ে ধরে রাখে, সেই সন্তানই একদিন বড় হয়ে সেই বাবা মা যে জীবন ধারাতে অভ্যস্ত সে জীবন ধারাটা পালটে দিতে চায়। তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতার কোন মূল্য দিতে চায় না। তাদের মতামতের গুরুত্ব না দিয়ে বরং আমাদের সিদ্ধান্ত তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাই।

আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি একটি বয়সে আমরাও বুড়ো হব। যাদের আমরা বলি বুড়ো হয়েছে, বেশী কথা বললে বলি; ভিমরতিতে ধরেছে, ভেবে কি দেখি আমিও বুড়ো হবো, কানে শুনবো না হয়তো, স্মৃতিভ্রম হবে, হাত-পা কাঁপবে। এমনও তো হতে পারে রাতের আধাঁরে হঠাৎ বেড়িয়ে পড়তে পারি অতীতের খোঁজে।

এখন যারা বলি আমি সন্তানের বোঝা হবো না, তাদের দয়া দােিণ্যর ওপর নির্ভর করবো না, আমি তাদের এই ধারনার সাথে কখনোই একমত হতে পারি না। আমার সন্তান আমাকে দেখবে না তো কাকে দেখবে? আমার সব কিছুইতো সন্তানের জন্য, সন্তানতো আমার। আমার সাথেতো সন্তানের রক্তের বন্ধন।

আসলে এই যে বন্ধন এই বন্ধন রার দায়িত্ব বাবা মা আর সন্তানেরই। এই বন্ধন অটুট থাকলে ব্যক্তি স্বাধীনতা ভোগ করার জন্য বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রয়োজন হয়না।

আমি তো মনে করি আমাদের সবার সুস্থ মন মানসিকতাই আমাদের সকল প্রকার ব্যক্তি স্বাধীনতা রার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সম। যে বাবা মা তিলে তিলে একটি সাজানো সংসার গড়ে তুলেছেন কি করে এই সংসার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করা যায়! কি করে সম্ভব এই সংসার গড়ার কারিগরদের উপো করা?

আমরা যদি মনে করতাম গুরুজন রাগ করেছেন, না হয় অন্যায়ই করেছে; আমরা কি পারিনা তাদের সবকিছু ভালবাসার গুনে মেনে নিতে। একটাইতো জীবন। বাবা-মা-সন্তান সবাই মিলে সেই জীবনের পুরোটাকে আনন্দে ভরপুর রাখতে কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করলে কি এমন ক্ষতি হবে?

তবে একথা অনস্বীকার্য সন্তানের পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও বয়স্ক মানুষদের প্রতি যথেষ্ট দায়িত্ব নেওয়া প্রয়োজন। যে মানুষ দেশের জন্যে কাজ করেছে, দেশের মানুষের জন্য সারাজীবন স্ব স্ব অবস্থান থেকে শ্রম দিয়েছেন। তাদেরকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাষ্ট্র থেকে সকল সুবিধা দেয়া অবশ্যই প্রয়োজন। আজ বিশ্ব প্রবীণ দিবসে সে কথাটিই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।

 

কেমন আছেন প্রবীণ নিবাসে নির্বাসিত দুখিনী মায়েরা

মা জননী নাইরে যাহার/ ত্রিভুবনে তাহার কেহ নাইরে/ মায়ের মতো আপন কেহ নাই।

মা কথাটি ছোট্ট অতি/ কিন্তু জেন ভাই/ তাহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভুবনে নাই।


মায়ের একধার দুধের দাম/কাটিয়া গায়ের চাম/পাপস বানাইলেও ঋণের শোধ হবে না/এমন দরদি ভবে কেউ হবে না আমার মা...
জীবনমুখী এ বাংলা গানের সুর অনেকের মোবাইল টিউন, ওয়েলকাম টিউনে শোনা যায়।

মায়ের প্রতি ভালোবাসা রয়েছে বলেই হয়তো এসব গান তারা ডাউনলোড করছেন। শুধু গান লোড কেন, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো এদেশে এখনও বহু সন্তান রয়েছেন, যারা মায়ের জন্য জীবন উত্সর্গ করতে পারেন। কিন্তু তার বিপরীতে মায়ের প্রতি সন্তানদের চরম অবহেলা-অবজ্ঞার চিত্র ধরা পড়ে বৃদ্ধাশ্রমসহ সমাজের নিম্নবিত্ত পরিবার ছাড়িয়ে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত। প্রবীণ মায়েরা কেমন রয়েছেন
তা জানার জন্য বিভিন্ন আশ্রম ঘুরে জানা গেছে, মৃত্যু মুহূর্তে সংসারবিচ্ছিন্ন লোকচক্ষুর আড়ালে পরবাসে থাকা মায়েদের ভিড় বাড়ছে!

নিষ্প্রাণ, বোধশূন্য, গতানুগতিক জীবনযাত্রার বাইরে থাকা ওইসব মায়ের সঙ্গে কথা হয়। কেমন আছেন তারা জানতে চাইলে অনেকেরই চোখে পানি এসে যায়! কেউ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন, ভাষা খুঁজে পান না। আবার কেউ পাছে সমাজে প্রতিষ্ঠিত সন্তানের মানহানি হয় কিংবা ছেলের রক্তচক্ষু দেখতে হয়
সে ভয়েও গণমাধ্যমে কথা বলতে চাননি। কেউ আবার নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেন—‘চোখের সামনে না থাকুক, তবুও আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।

প্রবীণ হিতৈষী সংঘের আশ্রমে এখন শুধু রাজধানী থেকে নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মায়েদের ঠাঁই হয়। কেমন আছেন? জানতে চাইলে জবাব আসে
কুয়াশাচ্ছন্ন পর্বতমালার মতো অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক! আর্থিক সচ্ছলতায় ভরা সংসারে প্রার্থিব সুখ পেয়ে এবং স্বজনদের কাছ থেকে ছিন্ন হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক সংযোগের সেতুবন্ধন। অনিশ্চয়তা, উত্কণ্ঠা, শঙ্কায় নিজের ঘরও হয়ে উঠেছে পরবাস। চারপাশটা কেবলই ফাঁকি আর মমতার ফাঁদ! মন তখন খুঁজে বেড়ায় একটা আশ্বাসআশ্রয়, নির্ভরতা আর শুশ্রূষা। সারাজীবন ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা সব সহায়-সম্পত্তি, ভিটেমাটি বিক্রি করে দিয়ে শেষ আশ্রয় হয় রাজধানীর আগারগাঁও প্রবীণ হিতৈষী সংঘের বৃদ্ধাশ্রমেআবেগাপ্লুত হয়ে কথাগুলো বলেন নার্গিস সুফিয়া আক্তার। রংপুরের বাসিন্দা সুফিয়ার (৫৫) স্বামী বড় পুলিশ অফিসার ছিলেন (নাম প্রকাশ করতে চাননি)। এক ছেলে লেখাপড়া শেষে বাবা-মাকে ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী হলেন; তিন মেয়ে যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। প্রতাপশালী স্বামীর আত্মম্ভরিতা ভেঙে খান খান হয়ে যায় দেখে মন বলে ওঠে বিকল্প পথ খুঁজি! পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল মানুষ দুটি রিক্ত জীবনের শেষপ্রান্তে এসে নির্জনে একাকীত্ব বেছে নিলেন। বিস্তৃত ও নিজস্ব পরিধি থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন সুফিয়া। এখন স্বামী-স্ত্রী দুজনে একই ছাদের নিচে। কিন্তু দুজনের মাঝখানে একটা ইট-পাথরের দেয়াল। কথাগুলো বলতে বলতে তার বুকের ভেতর থেকে নিঃশ্বাস ওঠে। চোখের পানি আড়াল করতেই দুটি কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া অসুস্থ সুফিয়া খাট থেকে নেমে সামনের বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ান। শান্ত কণ্ঠে বলেন, গভীর রাতে যখন ঘুম আসে না, তখন ছেলেমেয়ের মুখ মনে পড়ে; কিন্তু মনে করতে চাই না! কারও কাছে তো হাত পাততে হয় না। তবুও জোর করেই মনের মধ্যে এলোমেলো ভাবনা উঁকি দেয়। সব ভুলতে চাই। কাউকে চাই না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের হোমিও (অবসরপ্রাপ্ত) ডাক্তার ছেলেমেয়ের রক্তচক্ষুর ভয়ে নাম বলতে চাননি অশীতিপর ওই বৃদ্ধা। সংসারে দৈনন্দিন গতানুগতিক জীবনের অভ্যস্ততা তার সংসারে কাল হলো। তার দায়িত্বশীলতা ছেলেবউয়ের কাছে একরকম নাক গলানোর মতো! যা পরবর্তীতে কাল হয়ে দাঁড়ায়। সংসার জীবনে টুকটাক অশান্তিতে তার জন্য প্রায় ৫০ বছর বয়সী ছেলে জায়গা করে দিল বৃদ্ধাশ্রমে। অভিমানী স্বরে বললেন, ছেলে যেখানেই আমায় ফেলে রাখুক, আমার সামনে এলে সব কষ্ট ভুলে যাই। শুধু অপেক্ষায় থাকি ও কখন আমার সামনে আসবে! চোখ ছলছল করে ওঠে। নীরব থাকেন কিছুক্ষণ। কোনো সমস্যা নেই বললেও কথায় কথায় অনেক কিছুই বললেন। তার কষ্টটা বুকে চেপে রেখেছেন একরকম জোর করেই। এ প্রতিনিধি চলে আসতে গেলে হাত বাড়ান। তার চোখের ভাষা বলে দেয়আরও একটু থাকো পাশে, সময় যেন কাটে না! স্বামীহারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত পল্লবীর নার্গিস জাহানের মলিন পোশাক। তবুও এই বেশে ভালো আছি। সংসারে একটা মেয়ে। কিছুদিন ছিলাম। তারপর মায়ের আর জায়গা হলো না মেয়ের কাছে’—বললেন তিনি। ভাগ্যপীড়িত করুণ নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গে মোকাবিলায় মানসিক দৃঢ়তা তার মধ্যে। আবুজর গিফারি কলেজের প্রাক্তন এক প্রভাষকের (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) অভিমানে সংযত আবেগ—‘এইতো এখানে রেখে খাওয়া-পরার খরচ দিচ্ছে। প্রতি মাসে খরচ হয় প্রায় ১০ হাজার টাকা। ভালো না বাসলে কী আর এত খরচ ছেলেমেয়েরা দেয়? তারা দেশে নেই। ভালো হয়েছে, দেশে তো এখন স্বাভাবিক মৃত্যুরও গ্যারান্টি নেই। দুবছর আগেও তাদের কথা মনে করে কষ্ট হতো। এখন হয় না। যে যেখানেই থাকুক, তারা যেন থাকে দুধে-ভাতে। তবে প্রবীণ হিতৈষী সংঘের বৃদ্ধাশ্রমের মায়েরা জানান, এখানে এত লোক আসে। তারা প্রত্যেকই অনেক বয়সী এবং অসুস্থ। এখানে এটাস্টড বাথরুম না থাকায় কষ্ট হয়। রাতে কেউ কেউ অন্ধকারে পড়ে যান। একজন জানান, কদিন আগে অন্ধকারে পড়ে গিয়ে হাতে ব্যথা পেয়েছেন। তারা এটাস্টড বাথরুম এবং খাবারের মানটা আরও একটু ভালো করার আহ্বান জানান।

১২ মে। বেলা পৌনে ২টা। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাসে থাকা বৃদ্ধ নারগিস জাহানের (৭০) মুখোমুখি হতেই তিনি বিষণ্ন হয়ে পড়েন। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। অবুঝ অসহায় শিশু সন্তানটির ঊনিশ থেকে বিশ হলে যে মায়ের খানাদানা, ঘুম হারাম হয়ে যেত, সেই মাকে ৭ বছর ধরে দেখতে আসেনি তার হতভাগ্য সন্তান। শিক্ষকতা করেছেন প্রায় ২৯ বছর। ছেলেমেয়েদের নাম পরিচয় অথবা তারা কে কি করছেন তা না জানিয়ে শুধু বলেছেন, মৃত্যুর আগে তাদের দেখতে চান। ৪০৬ নম্বর রুমে নিবাস তার। ভীষণ অসুস্থ, বিছানায় শুইয়ে আছেন। অর্থের অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না। সন্তানরা যেমন দেখছেন না, তেমনি কোন স্বজন অথবা সহৃদয় সুজনের সাহায্যও মিলছে না।

নারগিস সুফিয়া (৬৬) আর এক মা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সঙ্গে কি যেন বলছিলেন। দু
পায়ে পানি জমে ফুলে রয়েছে। কোমরে দারুণ ব্যথা। স্বামী পুলিশের এসপি ফজলুল হক বসুনিয়া ১৯৯৮ সালে মারা যান। ৫ বছর ধরে প্রবীণ নিবাসে আছেন। একমাত্র ছেলে সাইফুল হক বসুনিয়া ১৫ বছর অস্ট্রেলিয়ায় জীবনযাপন করে সম্প্রতি সস্ত্রীক দেশে ফিরেছেন। মাকে দুবার দেখতে এসেছিলেন ফলমূল নিয়ে। নারগিস সুফিয়া জানান, ভয় পান চোখের পানি ফেলতে গিয়ে, শুনেছি চোখের পানি নাকি সন্তানদের অমঙ্গল ডেকে আনে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না। তিনি চান তার সন্তানের মঙ্গল। ফলমূল নয়, শেষ বয়সে ছেলের সঙ্গে থাকতে চান তিনি।

মীরা চৌধুরী জানালার গ্রিল ধরে বাইরের সবুজ চত্বরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। তার বয়স ৭৭ বছর, মা, কেমন আছেন বলতেই মুখ ঘুরিয়ে নির্বাক হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। ব্যথিত কণ্ঠে জানালেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। স্বামী জোসেফ চৌধুরী প্রায় ৮ বছর আগে মারা গেছেন। জীবনে যা কিছু গড়েছেন সবই একমাত্র সন্তানকে দিয়েছেন। এখন তিনি একা। তার শক্তি-সামর্থ্য কিছুই নেই। থাকছেন এ প্রবীণ নিবাসে। ছেলে অপূর্ব হাসান চৌধুরী আমেরিকায় থাকেন। ছেলের মুখখানা দেখতে বড়ই ইচ্ছে করে তার। ভাতের লোকমা মুখের কাছে নিতেই সন্তানদের চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। গলা দিয়ে খাবার নামে না।

দিলরুবা মাসুদ নামে এক মা চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে এ নিবাসেই মারা যান। ৭ বছর এ নিবাসে ছিলেন। ছেলে সৌদ আল মাসুদ আমেরিকা প্রবাসী। নিবাসে থাকা অবস্থায় ছেলে কোনদিনই মাকে দেখতে আসেননি। খোঁজও নেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিবাসে কর্মরত একজন বলেছেন, দিলরুবা মাসুদ অনেক দিন অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন। ছেলেকে দেখার জন্য শুধুই কাঁদতেন। এভাবেই কেটেছে তার জীবনের শেষ দিনগুলো। নিবাসে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা জানান, সন্তান সব সময় সন্তান। তাই তাদের নাম বলছি না। তারা অসম্মানিত হলে বড়ই কষ্ট পাব। তারা ভালো থাকুক এটাই খোদার কাছে দোয়া করি। সাংবাদিকদের জন্য তাদের বকা শুনতে হয়। সন্তানরা রাগ করেন। সন্তানরা নিষেধ করে দিয়েছেন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে। কোনভাবেই যেন তারা তাদের ছবি তুলতে না পারে তাও বলে দিয়েছে। মলিন মুখে তিনি বলেন, বেশ ভালোই আছি বাবা। সন্তানরা ভালো থাকুক, প্রত্যেক মা-ই তো তাই চান।

 

একটি মানবিক আবেদন: অভাবীদের কথা ভেবে হলেও কেউ খাবার নষ্ট/অপচয় করবেন না- ত্যাগের পরিবর্তে ভোগের প্রতিযোগিতা রমাদানের শিক্ষা নয়

 
জীবনের সবক্ষেত্রে এমনকি ঈদ, ইফতার ও সেহেরীতে কেন এত অসংযম ও অপচয়? অভিজাত শ্রেণীর এক বেলার আহারের পেছনে খরচ আমাদের সাধারণ মানুষের মত কয়েক টাকা নয়, তা কয়েক শত কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে কয়েক হাজার! আর পার্টি হলে তো কথাই নেই। বর্তমানে কোন কোন পরিবারের প্রতি বেলার খাবার সরবরাহ করে অনেক তথাকথিত দামী ও অভিজাত রেস্টুরেন্ট। আর অভিজাত শ্রেণীর খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে প্লেটে খাবার রেখে দেয়া বা নষ্ট করা যেন এখন অনেকটাই ফ্যাশন বা আভিজাত্যের প্রতীকে পরিনত হয়েছে। এদের মাত্র ১ জনের ১ বেলার নষ্ট করা খাবারের টাকা দিয়ে অসংখ্য অসহায় শিশুর আহারের ব্যবস্থা করা যেত। আর মহানবী ( স. ) এর সুন্নাত হচ্ছে খাবার নষ্ট না করা। এমনি আহার গ্রহণের পর আমাদের প্রিয় রসূলুল্লাহ (স. ) এর প্লেট আলাদা করা যেত। অসহায় তথা ক্ষুধার্ত শিশুদের কথা চিন্তা করে আমরা যদি শুধু খাবারের অপচয় না করে টাকাটাও ওদের জন্য জাতীয় ভাবে বরাদ্দ করার মানসিকতা অর্জন করতে পারি তাহলে এসব শিশুদের খাদ্যসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস।

সত্যিই সরকার আন্তরিক হলে অনেক কিছু করতে পারে। সরকারের হাত ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক সব কাজের জন্যই অনেক লম্বা। কিন্তু আমাদের সরকার সমূহ অনেক ক্ষেত্রেই জনগণের সাথে সম্পর্কহীন তাদের ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ!! কাজ নিয়ে ব্যস্ত।

আর অসহায় শিশুদের অবস্থা আজ বেশি খারাপ। তারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সরকারী আশ্রয় কেন্দ্রসমূহে সীমাহীন দূর্ণীতি, অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারনে তথাকথিত সরকারী আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর জন্যই ভালো আশ্রয়ের ব্যবস্থা আজ অতীব জরুরী। তারপরও ব্লগার, মিডিয়া প্রভৃতির সাহায্যে ব্যাপক জনমত ও সচেতনতা গড়ে তোলার মাধ্যমে এসব সরকারী আশ্রয় কেন্দ্রগুলোকে কার্যকর করতে হবে।

আমাদের দেশের বিত্তবানেরা হয়তো জানেন না দুনিয়াতে সম্পদ বেশী আখেরাতে তাদের হিসাব বেশী। আর জেনেই বা কি হবে তাদের তারা তো দুনিয়ার সুখটাকে বেশী মনে করে। আমাদের দেশের বিত্তবানরা সরকারকে অনুরোধ করে খেলার জন্য ষ্টেডিয়াম বানিয়ে দিবে, বোম্বে থেকে শাহরুক খান, আমির খান, সালমান খান, অক্ষয় কুমার, কারিনা কাপুর, কাটরিনা কাইফদের নিয়ে এসে জমজমাট ষ্টেজ শো করবে কোটি কোটি টাকা খরচ করে, এরা কি পারে না ঐ টাকা দিয়ে এই অসহায়কে একটু সাহায্য করতে।

এছাড়া অনেক দেশি-বিদেশি কোম্পানী বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও প্রতিভা খোঁজার নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করে থাকেন। তারা কি পারেন না মাত্র ৬৪টি জেলা ৬৪টি আশ্রয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে? যাতে করে অন্তত অসহায়দের খাদ্য -বস্ত্র - শিক্ষা -স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের মত মৌলিক চাহিদা গুলোর ব্যবস্থা করা যায়। এতে খুব বেশি টাকার দরকার হয় না।

-আপনার ধনীদের খাবার অপচয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।
 

১৮৭৩ সালে জন্ম নেয়া ১৩৮ বছরের খতেজা বিবি এই বয়সেও কেন ভিক্ষা করতে হয়? আমাদের কি কিছুই করার নেই? আমরা কি সামাজিক দায়িত্ব পালন করছি? কোথায় সরকার? হায় মানবতা!

তিনি এখনও স্পষ্ট দেখতে ও শুনতে পান। তার স্মরণশক্তি খুবই প্রখর। ঘরের কাজ শেষে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ কিলোমিটার পথ হেঁটে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়েন, রাখেন রোজাও।

ত্যাগের পরিবর্তে ভোগের প্রতিযোগিতা নয়। কবে যে এসবের অবসান?


 

আপনার সামান্য সহযোগিতায় পেয়ে অসহায়রা হতে পারে অনেক খুশি

স্বার্থের জুয়াখেলায় মত্ত এই বিচিত্র পৃথিবীতে আমরা এতটাই ব্যস্ত যে জীবনের জন্য ধ্রুব মৃত্যুর কথাটাই ভুলে গেছি। এমনি সামনে দিয়ে মৃত মানুষের লাশ নিয়ে গেলেও মনে হয় না মরব। অথচ ঠিক আগামী কালই আমাদের সবাইকে নিম্ন মানের সেলাই বিহীন কাপড় নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। যে কাফনে দুনিয়ার সম্পদ নিয়ে যাওয়ার মতো কোনো পকেটের ব্যবস্থা থাকে না।


এর পরও মানুষ পিতা-মাতার খোঁজ-খবর রাখে না, মিথ্যা বলে কিংবা ঘুষ খায়।

পিতা মাতা বেঁচে থাকতে আমরা বুঝি না। তাই সবার জন্য উত্তম, যাদের পিতা মাতা জীবিত আছে তাদের সাথে উত্তম আচরণ করা। আর যাদের পিতা-মাতা জীবিত নেই তাদের জন্য দোয়া করা, যেভাবে আল্লাহ আমাদের শিখিয়েছেন,
হে আল্লাহ তুমি আমার পিতা-মাতার সাথে সেই ধরনের করুণাপূর্ন আচরণ করো, যেভাবে তারা শিশুকালে আমার জন্য করেছিল

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন,
পিতা-মাতার সাথে সদ্ব-ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে আদের কে উহ শব্দটিও বলোনা এবং তাদেরকে ধমক দিওনা, তাদের সাথে শিষ্ঠাচার পূর্ন কথা বলো। সূরা বনী ইসরাঈল-২৩


তথ্যসূত্র- জাতীয় দৈনিকসমূহ ও ওয়েবসাইট

Monday, July 2, 2012

শবেবরাত


শবে বরাত ও প্রাসংগিক কিছু কথা
শবে বরাত আভিধানিক অর্থ অনুসন্ধান
‘শব’ ফারসি শব্দ। অর্থ রাত বা রজনী। বরাত শব্দটিও মূলে ফারসি। অর্থ ভাগ্য। দু’শব্দের একত্রে অর্থ হবে, ভাগ্য-রজনী। বরাত শব্দটি আরবি ভেবে অনেকেই ভুল করে থাকেন। কারণ ‘বরাত’ বলতে আরবি ভাষায় কোন শব্দ নেই।
যদি বরাত শব্দটি আরবি বারা’আত শব্দের অপভ্রংশ ধরা হয় তবে তার অর্থ হবে— সম্পর্কচ্ছেদ বা বিমুক্তিকরণ। কিন্তু কয়েকটি কারণে এ অর্থটি এখানে অগ্রাহ্য, মেনে নেয়া যায় না-
  • ১. আগের শব্দটি ফারসি হওয়ায় ‘বরাত’ শব্দটিও ফারসি হবে, এটাই স্বাভাবিক
  • ২. শা’বানের মধ্যরজনীকে আরবি ভাষার দীর্ঘ পরম্পরায় কেউই বারা’আতের রাত্রি হিসাবে আখ্যা দেননি।
  • ৩. রমযান মাসের লাইলাতুল ক্বাদরকে কেউ-কেউ লাইলাতুল বারা’আত হিসাবে নামকরণ করেছেন, শা‘বানের মধ্য রাত্রিকে নয়।
আরবি ভাষায় এ রাতটিকে কি বলা হয়?
আরবি ভাষায় এ রাতটিকে ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শা‘বান’ — শাবান মাসের মধ্য রজনী — হিসাবে অভিহিত করা হয়।
শাবানের মধ্যরাত্রির কি কোন ফযীলত বর্ণিত হয়েছে?
শাবান মাসের মধ্য রাত্রির ফযীলত সম্পর্কে কিছু হাদীস বর্ণিত হয়েছে:
১. আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন: এক রাতে আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে খুঁজে না পেয়ে তাঁকে খুঁজতে বের হলাম, আমি তাকে বাকী গোরস্তানে পেলাম। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বললেন: ‘তুমি কি মনে কর, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার উপর জুলুম করবেন?’ আমি বললাম: ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি ধারণা করেছিলাম যে আপনি আপনার অপর কোন স্ত্রীর নিকট চলে গিয়েছেন। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: ‘মহান আল্লাহ তা’লা শা‘বানের মধ্যরাত্রিতে নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হন এবং কালব গোত্রের ছাগলের পালের পশমের চেয়ে বেশী লোকদের ক্ষমা করেন।
হাদীসটি ইমাম আহমাদ তার মুসনাদে বর্ণনা করেন (৬/২৩৮), তিরমিযি তার সুনানে (২/১২১,১২২) বর্ণনা করে বলেন, এ হাদীসটিকে ইমাম বুখারী দুর্বল বলতে শুনেছি। অনুরূপভাবে হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে (১/৪৪৪, হাদীস নং ১৩৮৯) বর্ণনা করেছেন। হাদীসটির সনদ দুর্বল বলে সমস্ত মুহাদ্দিসগণ একমত।
২. আবু মূসা আল আশ’আরী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ‘আল্লাহ তা‘আলা শাবানের মধ্যরাত্রিতে আগমণ করে, মুশরিক ও ঝগড়ায় লিপ্ত ব্যক্তিদের ব্যতীত, তাঁর সমস্ত সৃষ্টিজগতকে ক্ষমা করে দেন। হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে (১/৪৫৫, হাদীস নং ১৩৯০),এবং তাবরানী তার মু’জামুল কাবীর (২০/১০৭,১০৮) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।
আল্লামা বূছীরি বলেন: ইবনে মাজাহ বর্ণিত হাদীসটির সনদ দুর্বল। তাবরানী বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে আল্লামা হাইসামী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) মাজমা‘ আয যাওয়ায়েদ (৮/৬৫) গ্রন্থে বলেনঃ ত্বাবরানী বর্ণিত হাদীসটির সনদের সমস্ত বর্ণনাকারী শক্তিশালী। হাদীসটি ইবনে হিব্বানও তার সহীহতে বর্ণনা করেছেন। এ ব্যাপারে দেখুন, মাওয়ারেদুজ জাম‘আন, হাদীস নং (১৯৮০), পৃঃ (৪৮৬)।
৩. আলী ইবনে আবী তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “যখন শা‘বানের মধ্যরাত্রি আসবে তখন তোমরা সে রাতের কিয়াম তথা রাতভর নামায পড়বে, আর সে দিনের রোযা রাখবে; কেননা সে দিন সুর্যাস্তের সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন: ক্ষমা চাওয়ার কেউ কি আছে যাকে আমি ক্ষমা করব। রিযিক চাওয়ার কেউ কি আছে যাকে আমি রিযিক দেব। সমস্যাগ্রস্ত কেউ কি আছে যে আমার কাছে পরিত্রাণ কামনা করবে আর আমি তাকে উদ্ধার করব। এমন এমন কেউ কি আছে? এমন এমন কেউ কি আছে? ফজর পর্যন্ত তিনি এভাবে বলতে থাকেন”।
হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে (১/৪৪৪, হাদীস নং ১৩৮৮) বর্ণনা করেছেন। আল্লামা বূছীরি (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) তার যাওয়ায়েদে ইবনে মাজাহ (২/১০) গ্রন্থে বলেন, হাদীসটির বর্ণনাকারীদের মধ্যে ইবনে আবি সুবরাহ রয়েছেন যিনি হাদীস বানাতেন। তাই হাদীসটি বানোয়াট।
উল্লিখিত আলোচনায় এটা স্পষ্ট যে, শা‘বানের মধ্যরাত্রির ফযীলত বিষয়ে যে সব হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার সবগুলোই দুর্বল অথবা বানোয়াট, আর তাই গ্রাহ্যতারহিত।
প্রাজ্ঞ আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, দুর্বল হাদীস দ্বারা কোন আহকাম- বিধান প্রমাণ করা যায় না। দুর্বল হাদীসের উপর আমল করার জন্য কয়েকটি শর্ত লাগিয়েছেন তারা। শর্তগুলো নিম্নরূপ -
  • ১. হাদীসটির মূল বক্তব্য অন্য কোন সহীহ হাদীসের বিরোধীতা করবেনা, বরং কোন শুদ্ধ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
  • ২. হাদীসটি একেবারেই দুর্বল অথবা বানোয়াট হলে চলবে না।
  • ৩. হাদীসটির উপর আমল করার সময় এটা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে প্রমাণিত বলে বিশ্বাস করা যাবে না। কারণ রাসূল থেকে প্রমাণিত বলে বিশ্বাস করলে রাসূলের উপর মিথ্যাচারিতার পাপ হবে, ফলে জাহান্নাম অবধারিত হয়ে পড়বে।
  • ৪. হাদীসটি ফাদায়িল তথা কোন আমলের ফযীলত বর্ণনা সংক্রান্ত হতে হবে। আহকাম (ওয়াজিব, মুস্তাহাব, হারাম, মাকরূহ) ইত্যাদি সাব্যস্তকারী না হতে হবে।
  • ৫. বান্দা ও তার প্রভুর মাঝে একান্ত ব্যক্তিগত কোন আমলের ক্ষেত্রে হাদীসটির নির্ভরতা নেয়া যাবে। তবে এ হাদীসের উপর আমল করার জন্য একে অপরকে আহবান করতে পারবে না।
এই শর্তাবলীর আলোকে যদি উপরোক্ত হাদীসগুলো পরীক্ষা করে দেখি তাহলে দেখতে পাই যে, উপরোক্ত হাদীসসমূহের মধ্যে শেষোক্ত _ আলী(রাদিয়াল্লাহু আনহু)বর্ণিত — হাদীসটি বানোয়াট। সুতরাং তার উপর আমল করা উম্মাতের আলেমদের ঐক্যমতে জায়েয হবে না।
প্রথম হাদীসটি দুর্বল, দ্বিতীয় হাদীসটিও অধিকাংশ আলেমের মতে দুর্বল, যদিও কোন-কোন আলেম এর বর্ণনাকারীগণকে শক্তিশালী বলে মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কেবলমাত্র বর্ণনাকারী শক্তিশালী হলেই হাদীস বিশুদ্ধ হওয়া সাব্যস্ত হয়না।
মোট কথাঃ প্রথম ও দ্বিতীয়, এ হাদীস দুটি দুর্বল। খুব দুর্বল বা বানোয়াট নয়। সে হিসেবে যৎকিঞ্চিৎ প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে এ রাত্রির ফযীলত রয়েছে।
এই সূত্রেই অনেক হাদীসবিদ শাবানের মধ্যরাতের ফযীলত রয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেনঃ
  • ইমাম আহমাদ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)। [ইবনে তাইমিয়া তার ইকতিদায়ে ছিরাতে মুস্তাকীমে (২/৬২৬) তা উল্লেখ করেছেন]
  • ইমাম আওযায়ী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)। [ইমাম ইবনে রাজাব তার ‘লাতায়েফুল মা‘আরিফ’ গ্রন্থে (পৃঃ১৪৪) তার থেকে তা বর্ণনা করেছেন]
  • শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)। [ইকতিদায়ে ছিরাতে মুস্তাকীম ২/৬২৬,৬২৭, মাজমু‘ ফাতাওয়া ২৩/১২৩, ১৩১,১৩৩,১৩৪]।
  • ইমাম ইবনে রাজাব আল হাম্বলী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)। [তার লাতায়েফুল মা‘আরিফ পৃঃ১৪৪ দ্রষ্টব্য]।
  • প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা নাসিরুদ্দিন আল-আলবানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) [ছিলছিলাতুল আহাদীস আস্‌সাহীহা ৩/১৩৫-১৩৯]
উপরোক্ত মুহাদ্দিসগনসহ আরো অনেকে এ রাত্রিকে ফযীলতের রাত বলে মত প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু আমরা যদি উপরে উল্লিখিত প্রথম ও দ্বিতীয় হাদীসটি পাঠ করে দেখি তাহলে দেখতে পাব —আল্লাহ তা‘আলা নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আহবান জানাতে থাকেন — হাদীসদ্বয়ে এ বক্তব্যই উপস্থাপিত হয়েছে। মুলত সহীহ হাদীসে সুস্পষ্ট এসেছে যে, “আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষাংশে – শেষ তৃতীয়াংশে- নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হয়ে আহবান জানাতে থাকেন ‘এমন কেউ কি আছে যে আমাকে ডাকবে আর আমি তার ডাকে সাড়া দেব? এমন কেউ কি আছে যে আমার কাছে কিছু চাইবে আর আমি তাকে দেব? আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আর আমি তাকে ক্ষমা করে দেব?” [বুখারী, হাদীস নং ১১৪৫, মুসলিম হাদীস নং ৭৫৮]
সুতরাং আমরা এ হাদীসদ্বয়ে অতিরিক্ত কোন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। সুতরাং এ রাত্রির বিশেষ কোন বিশেষত্ব আমাদের নজরে পড়ছে না। এজন্যই শাইখ আব্দুল আজীজ ইবনে বায (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) সহ আরো অনেকে এ রাত্রির অতিরিক্ত ফযীলত অস্বীকার করেছেন।
এ রাত্রি উদযাপন ও এতদসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর
প্রথম প্রশ্নঃ এ রাত্রি কি ভাগ্য রজনী?
উত্তরঃ না, এ রাত্রি ভাগ্য রজনী নয়, মূলতঃ এ রাত্রিকে ভাগ্য রজনী বলার পেছনে কাজ করছে সূরা আদ-দুখানের ৩ ও ৪ আয়াত দু’টির ভূল ব্যাখ্যা। তা হলোঃ
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَفِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ – سورة الدخان:3ـ4
আয়াতদ্বয়ের অর্থ হলোঃ “অবশ্যই আমরা তা (কোরআন) এক মুবারক রাত্রিতে অবতীর্ণ করেছি, অবশ্যই আমরা সতর্ককারী, এ রাত্রিতে যাবতীয় প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়”।
এ আয়াতদ্বয়ের তাফসীরে অধিকাংশ মুফাসসির বলেনঃ এ আয়াত দ্বারা রমযানের লাইলাতুল ক্বাদরকেই বুঝানো হয়েছে। যে লাইলাতুল কাদরের চারটি নাম রয়েছে: ১. লাইলাতুল কাদর, ২. লাইলাতুল বারা’আত, ৩. লাইলাতুচ্ছফ, ৪.লাইলাতুল মুবারাকাহ। শুধুমাত্র ইকরিমা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, এ আয়াত দ্বারা শা’বানের মধ্যরাত্রিকে বুঝানো হয়েছে। এটা একটি অগ্রহণযোগ্য বর্ণনা।
আল্লামা ইবনে কাসীর (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, আলোচ্য আয়াতে ‘মুবারক রাত্রি’ বলতে ‘লাইলাতুল ক্বাদর বুঝানো হয়েছে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ – سورةالقدر:1
আমরা এ কোরআনকে ক্বাদরের রাত্রিতে অবতীর্ণ করেছি। (সূরা আল-কাদরঃ১)।
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেনঃ
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُسورة البقرة:185
রমযান এমন একটি মাস যাতে কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। (সূরা আলবাকারাহঃ১৮৫)।
যিনি এ রাত্রিকে শা‘বানের মধ্যবর্তী রাত বলে মত প্রকাশ করেছেন, যেমনটি ইকরিমা থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি অনেক দূরবর্তী মত গ্রহণ করেছেন; কেননা কোরআনের সুস্পষ্ট বাণী তা রমযান মাসে বলে ঘোষণা দিয়েছে’। (তাফসীরে ইবনে কাসীর (৪/১৩৭)।
অনুরূপভাবে আল্লামা শাওকানীও এ মত প্রকাশ করেছেন। (তাফসীরে ফাতহুল ক্বাদীর (৪/৭০৯)।
সুতরাং ভাগ্য রজনী হলো লাইলাতুল ক্বাদর যা রমযানের শেষ দশদিনের বেজোড় রাত্রিগুলো।
আর এতে করে এও সাব্যস্ত হলো যে, এ আয়াতের তাফসীরে ইকরিমা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) মতভেদ করলেও তিনি শা’বানের মধ্য তারিখের রাত্রিকে লাইলাতুল বারা’আত নামকরণ করেননি।
দ্বিতীয় প্রশ্নঃ শা’বানের মধ্যরাত্রি উদযাপন করা যাবে কিনা?
উত্তরঃ শা’বানের মধ্যরাত্রি পালন করার কি হুকুম এ নিয়ে আলেমদের মধ্যে তিনটি মত রয়েছে:
  • এক. শা‘বানের মধ্য রাত্রিতে মাসজিদে জামাতের সাথে নামায ও অন্যান্য ইবাদত করা জায়েয । প্রসিদ্ধ তাবেয়ী খালেদ ইবনে মি‘দান, লুকমান ইবনে আমের সুন্দর পোশাক পরে, আতর খোশবু, শুরমা মেখে মাসজিদে গিয়ে মানুষদের নিয়ে এ রাত্রিতে নামায আদায় করতেন। এ মতটি ইমাম ইসহাক ইবনে রাহওয়ীয়াহ থেকেও বর্ণিত হয়েছে। (লাতায়েফুল মা‘আরেফ পৃঃ১৪৪)। তারা তাদের মতের পক্ষে কোন দলীল পেশ করেননি। আল্লামা ইবনে রাজাব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) তাদের মতের পক্ষে দলীল হিসাবে বলেনঃ তাদের কাছে এ ব্যাপারে ইসরাইলি তথা পূর্ববর্তী উম্মাতদের থেকে বিভিন্ন বর্ণনা এসেছিল, সে অনুসারে তারা আমল করেছিলেন। তবে পূর্বে বর্ণিত বিভিন্ন দুর্বল হাদীস তাদের দলীল হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকবে।
  • দুই. শা‘বানের মধ্যরাত্রিতে ব্যক্তিগতভাবে ইবাদত বন্দেগী করা জায়েয। ইমাম আওযা‘য়ী, শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া, এবং আল্লামা ইবনে রজব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহিম) এ মত পোষণ করেন। তাদের মতের পক্ষে তারা যে সমস্ত হাদীস দ্বারা এ রাত্রির ফযীলত বর্ণিত হয়েছে সে সমস্ত সাধারণ হাদীসের উপর ভিত্তি করে ব্যক্তিগতভাবে ইবাদত করাকে জায়েয মনে করেন।
  • তিন: এ ধরণের ইবাদত সম্পূর্ণরূপে বিদ’আত — চাই তা ব্যক্তিগতভাবে হোক বা সামষ্টিকভাবে। ইমাম ‘আতা ইবনে আবি রাবাহ, ইবনে আবি মুলাইকা, মদীনার ফুকাহাগণ, ইমাম মালেকের ছাত্রগণ, ও অন্যান্য আরো অনেকেই এ মত পোষণ করেছেন। এমনকি ইমাম আওযায়ী যিনি শাম তথা সিরিয়াবাসীদের ইমাম বলে প্রসিদ্ধ তিনিও এ ধরনের ঘটা করে মাসজিদে ইবাদত পালন করাকে বিদ‘আত বলে ঘোষণা করেছেন।
তাদের মতের পক্ষে যুক্তি হলো :
  • ১.এ রাত্রির ফযীলত সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন দলীল নেই। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ রাত্রিতে কোন সুনির্দিষ্ট ইবাদত করেছেন বলে সহীহ হাদীসে প্রমাণিত হয়নি। অনুরূপভাবে তার কোন সাহাবী থেকেও কিছু বর্ণিত হয়নি। তাবেয়ীনদের মধ্যে তিনজন ব্যতীত আর কারো থেকে বর্ণিত হয়নি। আল্লামা ইবনে রজব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেনঃ শা‘বানের রাত্রিতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অথবা তার সাহাবাদের থেকে কোন নামায পড়া প্রমাণিত হয়নি। যদিও শামদেশীয় সুনির্দিষ্ট কোন কোন তাবেয়ীন থেকে তা বর্ণিত হয়েছে। (লাতায়েফুল মা‘আরিফঃ১৪৫)।
শাইখ আব্দুল আযীয ইবনে বায (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেনঃ ‘এ রাত্রির ফযীলত বর্ণনায় কিছু দুর্বল হাদীস এসেছে যার উপর ভিত্তি করা জায়েয নেই, আর এ রাত্রিতে নামায আদায়ে বর্ণিত যাবতীয় হাদীসই বানোয়াট, আলেমগণ এ ব্যাপারে সতর্ক করে গেছেন’।
  • ২. হাফেজ ইবনে রজব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) যিনি কোন কোন তাবেয়ীনদের থেকে এ রাত্রির ফযীলত রয়েছে বলে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেনঃ ঐ সমস্ত তাবেয়ীনদের কাছে দলীল হলো যে তাদের কাছে এ ব্যাপারে ইসরাইলি কিছু বর্ণনা এসেছে।তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, যারা এ রাত পালন করেছেন তাদের দলীল হলো, যে তাদের কাছে ইসরাইলি বর্ণনা এসেছে, আমাদের প্রশ্নঃ ইসরাইলি বর্ণনা এ উম্মাতের জন্য কিভাবে দলীল হতে পারে?
  • ৩. যে সমস্ত তাবেয়ীনগণ থেকে এ রাত উদযাপনের সংবাদ এসেছে তাদের সমসাময়িক প্রখ্যাত ফুকাহা ও মুহাদ্দিসীনগণ তাদের এ সব কর্মকান্ডের নিন্দা করেছেন। যারা তাদের নিন্দা করেছেন তাদের মধ্যে প্রখ্যাত হলেনঃ ইমাম আতা ইবনে আবি রাবাহ, যিনি তার যুগের সর্বশ্রেষ্ট মুফতি ছিলেন, আর যার সম্পর্কে সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেছিলেনঃ তোমরা আমার কাছে প্রশ্নের জন্য একত্রিত হও, অথচ তোমাদের কাছে ইবনে আবি রাবাহ রয়েছে। সুতরাং যদি ঐ রাত্রি উদযাপনকারীদের পক্ষে কোন দলীল থাকত, তাহলে তারা ‘আতা ইবনে আবি রাবাহর বিপক্ষে তা অবশ্যই পেশ করে তাদের কর্মকাণ্ডের যথার্থতা প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন, অথচ এরকম করেছেন বলে প্রমাণিত হয়নি।
  • ৪. পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, যে সমস্ত দুর্বল হাদীসে ঐ রাত্রির ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, তাতে শুধুমাত্র সে রাত্রিতে আল্লাহর অবতীর্ণ হওয়া এবং ক্ষমা করা প্রমাণিত হয়েছে, এর বাইরে কিছুই বর্ণিত হয়নি। মুলতঃ এ অবতীর্ণ হওয়া ও ক্ষমা চাওয়ার আহবান প্রতি রাতেই আল্লাহ তা’আলা করে থাকেন। যা সুনির্দিষ্ট কোন রাত বা রাতসমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। এর বাইরে দুর্বল হাদীসেও অতিরিক্ত কোন ইবাদত করার নির্দেশ নেই।
  • ৫. আর যারা এ রাত্রিতে ব্যক্তিগতভাবে আমল করা জায়েয বলে মন্তব্য করেছেন তাদের মতের পক্ষে কোন দলীল নেই, কেননা এ রাত্রিতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বা তার সাহাবা কারো থেকেই ব্যক্তিগত কিংবা সামষ্টিক কোন ভাবেই কোন প্রকার ইবাদত করেছেন বলে বর্ণিত হয়নি। এর বিপরীতে শরীয়তের সাধারণ অনেক দলীল এ রাত্রিকে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে, তম্মধ্যে রয়েছেঃআল্লাহ বলেনঃ“আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম”। (সূরা আল-মায়েদাহঃ ৩)।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ (যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটাবে যা এর মধ্যে নেই, তা তার উপর নিক্ষিপ্ত হবে)। (বুখারী, হাদীস নং ২৬৯৭)।
তিনি আরো বলেছেনঃ (যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করবে যার উপর আমাদের দ্বীনের মধ্যে কোন নির্দেশ নেই তা অগ্রহণযোগ্য)। (মুসলিম, হাদীস নং ১৭১৮)। 
শাইখ আব্দুল আজীজ ইবনে বায (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেনঃ আর ইমাম আওযা‘য়ী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) যে, এ রাতে ব্যক্তিগত ইবাদত করা ভাল মনে করেছেন, আর যা হাফেয ইবনে রাজাব পছন্দ করেছেন, তাদের এ মত অত্যন্ত আশ্চার্যজনক বরং দুর্বল; কেননা কোন কিছু যতক্ষন পর্যন্ত না শরীয়তের দলীলের মাধ্যমে জায়েয বলে সাব্যস্ত হবে ততক্ষন পর্যন্ত কোন মুসলিমের পক্ষেই দ্বীনের মধ্যে তার অনুপ্রবেশ ঘটাতে বৈধ হবে না। চাই তা ব্যক্তিগতভাবে করুক বা সামষ্টিক- দলবদ্ধভাবে। চাই গোপনে করুক বা প্রকাশ্য। কারণ বিদ‘আতকর্ম অস্বীকার করে এবং তা থেকে সাবধান করে যে সমস্ত প্রমাণাদি এসেছে সেগুলো সাধারণভাবে তার বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। (আত্‌তাহযীর মিনাল বিদ‘আঃ১৩)।
  • ৬. শাইখ আব্দুল আযীয ইবনে বায (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) আরো বলেনঃ সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “তোমরা জুম‘আর রাত্রিকে অন্যান্য রাত থেকে ক্বিয়াম/ নামাযের জন্য সুনির্দিষ্ট করে নিও না, আর জুম‘আর দিনকেও অন্যান্য দিনের থেকে আলাদা করে রোযার জন্য সুনির্দিষ্ট করে নিও না, তবে যদি কারো রোযার দিনে সে দিন ঘটনাচক্রে এসে যায় সেটা ভিন্ন কথা”। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৪৪, ১৪৮)।
যদি কোন রাতকে ইবাদতের জন্য সুনির্দিষ্ট করা জায়েয হতো তবে অবশ্যই জুম‘আর রাতকে ইবাদতের জন্য বিশেষভাবে সুনির্দিষ্ট করা জায়েয হতো; কেননা জুম‘আর দিনের ফযীলত সম্পর্কে হাদীসে এসেছে যে, “সুর্য যে দিনগুলোতে উদিত হয় তম্মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ট দিন, জুম‘আর দিন”। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৮৪)।
সুতরাং যেহেতু রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুম‘আর দিনকে বিশেষভাবে ক্বিয়াম/নামাযের জন্য সুনির্দিষ্ট করা থেকে নিষেধ করেছেন সেহেতু অন্যান্য রাতগুলোতে অবশ্যই ইবাদতের জন্য সুনির্দিষ্ট করে নেয়া জায়েয হবে না। তবে যদি কোন রাত্রের ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন দলীল এসে যায় তবে সেটা ভিন্ন কথা। আর যেহেতু লাইলাতুল ক্বাদর এবং রমযানের রাতের ক্বিয়াম/নামায পড়া জায়েয সেহেতু রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে এ রাতগুলোর ব্যাপারে স্পষ্ট হাদীস এসেছে।
তৃতীয় প্রশ্নঃ শা‘বানের মধ্যরাত্রিতে হাজারী নামায পড়ার কী হুকুম?
উত্তরঃ শা‘বানের মধ্যরাত্রিতে একশত রাকাত নামাযের প্রতি রাকাতে দশবার সূরা কুল হুওয়াল্লাহ (সূরা ইখলাস) দিয়ে নামাজ পড়ার যে নিয়ম প্রচলিত হয়েছে তা সম্পূর্ণরূপে বিদ‘আত।
এ নামাযের প্রথম প্রচলন
এ নামাযের প্রথম প্রচলন হয় হিজরী ৪৪৮ সনে। ফিলিস্তিনের নাবলুস শহরের ইবনে আবিল হামরা নামীয় একলোক বায়তুল মুকাদ্দাস আসেন। তার তিলাওয়াত ছিল সুমধুর। তিনি শা‘বানের মধ্যরাত্রিতে নামাযে দাঁড়ালে তার পিছনে এক লোক এসে দাঁড়ায়, তারপর তার সাথে তৃতীয় জন এসে যোগ দেয়, তারপর চতুর্থ জন। তিনি নামায শেষ করার আগেই বিরাট একদল লোক এসে তার সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে।
পরবর্তী বছর এলে, তার সাথে অনেকেই যোগ দেয় ও নামায আদায় করে। এতে করে মাসজিদুল আক্‌সাতে এ নামাযের প্রথা চালু হয়। কালক্রমে এ নামায এমনভাবে আদায় হতে লাগে যে অনেকেই তা সুন্নাত মনে করতে শুরু করে। (ত্বারতুসীঃ হাওয়াদেস ও বিদ‘আ পৃঃ১২১, ১২২, ইবনে কাসীরঃ বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১৪/২৪৭, ইবনুল কাইয়েমঃ আল-মানারুল মুনিফ পৃঃ৯৯)।
এ নামাযের পদ্ধতি
প্রথা অনুযায়ী এ নামাযের পদ্ধতি হলো, প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাস দশবার করে পড়ে মোট একশত রাকাত নামায পড়া। যাতে করে সূরা ইখলাস ১০০০ বার পড়া হয়। (এহইয়ায়ে উলুমুদ্দীন (১/২০৩)।
এ ধরণের নামায সম্পূর্ণ বিদ‘আত। কারণ এ ধরণের নামাযের বর্ণনা কোন হাদীসের কিতাবে আসেনি। কোন কোন বইয়ে এ সম্পর্কে যে সকল হাদীস উল্লেখ করা হয় সেগুলো কোন হাদীসের কিতাবে আসেনি। আর তাই আল্লামা ইবনুল জাওযী (মাওদু‘আত ১/১২৭-১৩০), হাফেয ইরাকী (তাখরীজুল এহইয়া), ইমাম নববী (আল-মাজমু‘ ৪/৫৬), আল্লামা আবু শামাহ (আল-বা‘েয়স পৃঃ৩২-৩৬), শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা, (ইকতিদায়ে ছিরাতুল মুস্তাকীম ২/৬২৮), আল্লামা ইবনে ‘আররাক (তানযীহুশ শরীয়াহ ২/৯২), ইবনে হাজার আল-আসকালানী, আল্লামা সূয়ূতী (আল-আমর বিল ইত্তেবা পৃঃ৮১, আল-লাআলিল মাসনূ‘আ ২/৫৭), আল্লামা শাওকানী (ফাওয়ায়েদুল মাজমু‘আ পৃঃ৫১) সহ আরো অনেকেই এ গুলোকে “বানোয়াট হাদীস” বলে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন।
এ ধরণের নামাযের হুকুম
সঠিক জ্ঞানের অধিকারী আলেমগণের মতে এ ধরণের নামায বিদ‘আত; কেননা এ ধরনের নামায আল্লাহর রাসূলও পড়েননি। তার কোন খলীফাও পড়েননি। সাহাবাগণও পড়েননি। হেদায়াতের ইমাম তথা আবু হানিফা, মালেক, শাফেয়ী, আহমাদ, সাওরী, আওযায়ী, লাইস’সহ অন্যান্যগণ কেউই এ ধরণের নামায পড়েননি বা পড়তে বলেননি।
আর এ ধরণের নামাযের বর্ণনায় যে হাদীসসমূহ কেউ কেউ উল্লেখ করে থাকেন তা উম্মাতের আলেমদের ইজমা অনুযায়ী বানোয়াট। (এর জন্য দেখুনঃ ইবনে তাইমিয়ার মাজমুল‘ ফাতাওয়া ২৩/১৩১,১৩৩,১৩৪, ইকতিদায়ে ছিরাতে মুস্তাকীম ২/৬২৮, আবু শামাহঃ আল-বা‘য়েছ পৃঃ ৩২-৩৬, রশীদ রিদাঃ ফাতাওয়া ১/২৮, আলী মাহফুজ, ইবদা‘ পৃঃ২৮৬,২৮৮, ইবনে বাযঃ আত্‌তাহযীর মিনাল বিদ‘আ পৃঃ১১-১৬)।
চতুর্থ প্রশ্নঃ শা‘বানের মধ্যরাত্রির পরদিন কি রোযা রাখা যাবে?
উত্তরঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বহু সহীহ হাদীসে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি শা‘বান মাসে সবচেয়ে বেশী রোযা রাখতেন। (এর জন্য দেখুনঃ বুখারী, হাদীস নং ১৯৬৯, ১৯৭০, মুসলিম, হাদীস নং ১১৫৬, ১১৬১, মুসনাদে আহমাদ ৬/১৮৮, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ২৪৩১, সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস নং ২০৭৭, সুনানে তিরমিঝি, হাদীস নং ৬৫৭)।
সে হিসাবে যদি কেউ শা‘বান মাসে রোযা রাখেন তবে তা হবে সুন্নাত। শাবান মাসের শেষ কয়েক দিন ছাড়া বাকী যে কোন দিন রোযা রাখা জায়েয বা সওয়াবের কাজ। তবে রোজা রাখার সময় মনে করতে হবে যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেহেতু শা‘বান মাসে রোজা রেখেছিলেন তাকে অনুসরন করে রোযা রাখা হচ্ছে।
অথবা যদি কারও আইয়ামে বিদের নফল রোযা তথা মাসের ১৩,১৪,১৫ এ তিনদিন রোযা রাখার নিয়ম থাকে তিনিও রোযা রাখতে পারেন। কিন্তু শুধুমাত্র শা‘বানের পনের তারিখ রোযা রাখা বিদ‘আত হবে। কারণ শরীয়তে এ রোযার কোন ভিত্তি নেই।
আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর রাসূলের পরিপূর্ণ পদাঙ্ক অনুসরন করে চলার তৌফিক দিন। আমীন।
টীকা:7. যদি শা‘বানের মধ্যরাত্রিকে উদযাপন করা বা ঘটা করে পালন করা জায়েয হতো তাহলে অবশ্যই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ ব্যাপারে আমাদের জানাতেন। বা তিনি নিজেই তা করতেন। আর এমন কিছু তিনি করে থাকতেন তাহলে সাহাবাগণ অবশ্যই তা উম্মাতের কাছে বর্ণনা করতেন। তারা নবীদের পরে জগতের শ্রেষ্টতম মানুষ, সবচেয়ে বেশী নসীহতকারী, কোন কিছুই তারা গোপন করেননি’। (আত্‌তহযীর মিনাল বিদা’১৫১৬)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমাদের কাছে স্পষ্ট হলো যে, কুরআন, হাদীস ও গ্রহণযোগ্য আলেমদের বাণী থেকে আমরা জানতে পারলাম শা‘বানের মধ্য রাত্রিকে ঘটা করে উদযাপন করা— চাই তা নামাযের মাধ্যমে হোক অথবা অন্য কোন ইবাদতের মাধ্যেমে— অধিকাংশ আলেমদের মতে জগন্যতম বিদ‘আত। শরীয়তে যার কোন ভিত্তি নেই। বরং তা’ সাহাবাদের যুগের পরে প্রথম শুরু হয়েছিল। যারা সত্যের অনুসরণ করতে চায় তাদের জন্য দ্বীনের মধ্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা করতে বলেছেন তাই যথেষ্ট।


---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
for more reading:

প্রত্যেক মুসলমানই অবগত আছেন ইসলামী শরিয়তের মূল উৎস দু’টি কুরআন ও হাদিস। কুরআন ও হাদিসে যে ইবাদতের যতটুকু গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তার চেয়ে একটু বেশি বা কম গুরুত্ব দেয়ার কোনো অধিকার কোনো মুসলিমের নেই। শবেবরাত নামক বিষয়টি কুরআনুল কারিমে আদৌ উল্লেখ করা হয়নি। এটাই হচ্ছে উম্মতের মুহাকিক আলিম ও ইমামদের মতামত। কেউ কেউ দাবি করে থাকেন, সূরা আদ্-দোখানে ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ’- বরকতময় রাত বলতে শবেবরাতকেই বোঝানো হয়েছে।

ইমাম ইবনে কাছির রা: বলেন, বরকতময় রাত বলতে সূরা দোখানে শবেকদরকে বোঝানো হয়েছে। কারণ এখানে কুরআন নাজিলের কথা বলা হয়েছে। আর সেটা তো সূরা কদরে স্পষ্ট করেই বলা আছে। আর কুরআন রমজান মাসেই নাজিল হয়েছে, সেটাও সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে সূরা বাকারায়। তিনি আরো বলেন, কেউ যদি বলে, বরকতময় রাত বলতে মধ্য শাবানের রাত বোঝানো হয়েছে, যেমনটি ইকরিমা কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, তাহলে সে প্রকৃত সত্য থেকে অনেক দূরে অবস্থান করল।

শবেবরাতে মানুষের হায়াত, মাউত ও রিজিকের বার্ষিক ফায়সালা হওয়াসংক্রান্ত যে হাদিসটি উসমান বিন মুহাম্মদ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, সে সম্পর্কে তিনি বলেছেন, হাদিসটি মুরসাল। অর্থাৎ হাদিসের প্রথম বর্ণনাকারী হিসেবে যে সাহাবি রাসূলুল্লাহ সা: থেকে হাদিসটি শুনেছেন তার কোনো উল্লেখ নেই। ফলে এমন দুর্বল হাদিস দিয়ে কুরআন ও সহিহ হাদীসের অকাট্য বক্তব্যকে খণ্ডন করা যায় না। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফসির ইবনে কাছির, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩১৬১)।

ইমাম কুরতুবি বলেন, বরকতময় রাত্রি বলতে কদরের রাতকে বোঝানো হয়েছে। যদিও কেউ বা বলেছেন সেটা হচ্ছে মধ্য শাবানের রাত। ইকরিমাও বলেছেন সেটি হচ্ছে মধ্য শাবানের রাত। তবে, প্রথম মতটি অধিকতর শুদ্ধ। কেননা, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আমি এ কুরআনকে লাইলাতুল কদরে নাজিল করেছি। এ প্রসঙ্গে মানুষের হায়াত, মাউত, রিজিক ইত্যাদির ফায়সালা শবেবরাতে সম্পন্ন করা হয় বলে যে রেওয়ায়েত এসেছে, সেটাকে তিনি অগ্রহণযোগ্য বলে বর্ণনা করেন। তিনি পুনরায় উল্লেখ করেন, সহিহ শুদ্ধ কথা হচ্ছে- এ রাতটি লাইলাতুল কদর।

অতঃপর তিনি প্রখ্যাত ফকিহ কাজি আবু বকর ইবনুল আরাবির উদ্ধৃতি পেশ করেন, ‘জমহুর আলিমদের মতামত হচ্ছে- এ রাতটি লাইলাতুল কদর। কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন এটা মধ্য শাবানের রাত। এ কথাটি একেবারেই বাতিল। কারণ আল্লাহ তাঁর অকাট্য বাণী কুরআনে বলেছেন, রমজান হচ্ছে ওই মাস, যে মাসে কুরআন নাজিল করা হয়েছে। যেথায় তিনি মাস উল্লেখ করে দিয়েছেন। আর বরকতময় রাত বলে লাইলাতুল কদরকে উল্লেখ করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি এ রাতটাকে রমজান থেকে সরিয়ে অন্য মাসে নিয়ে যায়, সে মূলত আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে বসে। মধ্য শাবানের রাতটির ফজিলত এবং এ রাতে হায়াত, মাউতের ফায়সালাসংক্রান্ত কোনো একটি হাদিসও সহিহ এবং নির্ভরযোগ্য নয়। কাজেই কেউ যেন সেগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত না করে। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন : তাফসিরে কুরতুবি ষোড়শ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১২৬-১২৮)। ইমাম তাবারি তাফসিরে তাবারিতে বরকতময় রাতের তাফসিরে উল্লেখ করেন : কাতাদাহ রা: বর্ণিত এ রাতটি লাইলাতুল কদরের রাত। প্রতি বছরের শাবানের মতামতটিও উল্লেখ করেন। পরিশেষে তিনি মন্তব্য করেন : লাইলাতুল কদরের মতটিই শুদ্ধ ও সহিহ। কারণ এখানে কুরআন নাজিলের কথা বলা হয়েছে। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন : তাফসিরে তাবারি ১১ খণ্ড, পৃষ্ঠা : ২২১-২২৩)।

আল্লামা মুহাম্মদ আল আমিন আশ শিনকিতি রা: সূরা দোখানের বরকতময় রাতের তাফসিরে বলেন, এটি হচ্ছে রমজান মাসের কদরের রাত। মধ্য শাবানের রাত হিসেবে সেটিকে বোঝানো হয়েছে মনে করা, যেমনটি ইকরিমা কর্তৃক বর্ণিত রেওয়াতে বলা হয়েছে, একটি মিথ্যা দাবি ছাড়া আর কিছু নয়। কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধী এ দাবিটি নিঃসন্দেহে হকের বিপরীত যেকোনো কথাই বাতিল। কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধী যে হাদিসগুলো কেউ কেউ বর্ণনা করে থাকেন, যাতে বলা হয় এ রাতটি হচ্ছে মধ্য শাবানের রাত, সে হাদিসগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। সেগুলোর কোনোটার সনদই সহিহ নয়। ইবনুল আরাবিসহ অনেক মুহাকিক আইম্মায়ে কেরাম এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে বলেছেন, বড়ই আফসোস ওই মুসলমানদের জন্য যারা কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধিতা করে কুরআন বা সহিহ হাদিসের দলিল ছাড়াই। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন : আদওয়াউল বায়ান, সপ্তম খণ্ড, পৃ: ৩১৯)।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মুফতি শফি র: এ বিষয়ে মাআরেফুল কুরআনে বলেন, বরকতময় রাত বলতে বেশির ভাগ তাফসিরবিদের মতে এখানে শবেকদর বোঝানো হয়েছে যা রমজান মাসের শেষ দশকে হয়। কেউ কেউ আলোচ্য আয়াতে বরকতের রাত্রির অর্থ দিয়েছেন শবেবরাত। কিন্তু এটা শুদ্ধ নয়। কেননা, এখানে সর্বাগ্রে কুরআন অবতরণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর কুরআন যে রমজান মাসে নাজিল হয়েছে, তা কুরআনের বর্ণনা দ্বারাই প্রমাণিত। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন : মাআরিফুল কুরআন, পৃষ্ঠা : ১২৩৫)।

কুরআন দিয়েই কুরআনের তাফসির গ্রহণ করার সুযোগ থাকলে সেটাই গ্রহণ করতে হবে। এটাই ওলামায়ে উম্মতের এজমাহ। শবেবরাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদিসগুলো দুই প্রকার : প্রথমত. শবেবরাতে কত রাকাত নামাজ পড়তে হবে, সূরা এখলাস, আয়াতুল কুরসি প্রতি রাকাতে কতবার পড়তে হবে ইত্যাদি এবং সে আমলগুলোর বিস্তারিত ছওয়াবের ফিরিস্তিসংক্রান্ত হাদিসগুলো একেবারেই জাল এবং বানোয়াট। আর দ্বিতীয় প্রকার হাদিস হলো- এ রাতের ফজিলত, ইবাদতের গুরুত্ব ইত্যাদি বিষয়ে। এসব হাদিসের কোনোটাই সহিহ হিসেবে প্রমাণিত হয়নি। বরং সবই জয়িফ (দুর্বল)। তবে সবই মাউজু (জাল বা বানোয়াট নয়)।

শবেবরাতসংক্রান্ত কোনো একটি হাদিসও বুখারি ও মুসলিম গ্রন্থদ্বয়ে আসেনি। আর বাকি চারটি গ্রন্থে বা অন্যান্য আরো কিছু গ্রন্থে এসংক্রান্ত যে হাদিসগুলো এসেছে, তার একটিও সহিহ হাদিসের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। হাদিস বিশারদদের মন্তব্যসহকারে শবেবরাতসংক্রান্ত কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হলো : ১) আলী রা:-এর বরাত দিয়ে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা: এরশাদ করেছেন, ১৫ শাবানের রাতে তোমরা বেশি বেশি করে ইবাদত করো এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো। এ রাতে আল্লাহ তায়ালা সূর্যাস্তের সাথে সাথেই দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন। বলতে থাকেন : ‘কে আছো আমার কাছে গুনাহ মাফ চাইতে। আমি তাকে মাফ করতে প্রস্তুত। কে আছো রিজিক চাইতে! আমি তাকে রিজিক দিতে প্রস্তুত। কে আছো বিপদগ্রস্ত! আমি তাকে বিপন্মুক্ত করতে প্রস্তুত। কে আছো... এভাবে (বিভিন্ন প্রয়োজনের নাম নিয়ে) ডাকা হতে থাকে সুবহে সাদেক পর্যন্ত।’ ইবনে মাজাহ কর্তৃক হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে।

এ হাদিসটি যে আদৌ সহিহ নয় সে মন্তব্য করতে গিয়ে প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ ইমাম হাফেজ শিহাবুদ্দিন যাওয়ায়েদে ইবনে মাজাহ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, হাদিসটির সনদ জয়িফ (দুর্বল)। কারণ অনির্ভরযোগ্য।

২) আয়েশা রা: বরাতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি এক রাতে দেখতে পাই, রাসূলুল্লাহ সা: আমার পাশে নেই। আমি তাঁর সন্ধানে বের হলাম। দেখি, তিনি জান্নাতুল বাকি (কবরস্থানে) অবস্থান করছেন। ঊর্ধ্বাকাশের দিকে তাঁর মন্তক ফেরানো। আমাকে দেখে বললেন, আয়েশা, তুমি কি আশঙ্কা করেছিলে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: তোমার প্রতি অবিচার করছেন। আয়েশা রা: বললেন, এমন ধারণা করিনি, তবে মনে করেছিলাম, আপনি অন্য কোনো বিবির সান্নিধ্যে গিয়েছিলেন কি না! রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, আল্লাহ তায়ালা ১৫ শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং কালব গোত্রের সমুদয় বকরির সব পশমের পরিমাণ মানুষকে মাফ করে দেন। (তিরমিজি, ইবানে মাজাহ)। ইমাম তিরমিজি হাদিসটি বর্ণনা করে নিজেই মন্তব্য করেছেন, আয়েশা রা: বর্ণিত এ হাদিসটি হাজ্জাজ বিন আরতাআহ্ ছাড়া আর কেউ বর্ণনা করেছেন বলে জানা নেই।

ইমাম বোখারি বলেছেন, এ হাদিসটি জয়িফ (দুর্বল)। হাজ্জাজ বিন আরতাআহ্ বর্ণনা করেছেন ইয়াহ্ইয়া বিন আবি কাছির থেকে। অথচ হাজ্জাজ ইয়াহ্ইয়া থেকে আদৌ হাদিস শোনেননি। ইমাম বোখারি আরো বলেছেন, এমনকি ইয়াহ্ইয়া বিন আবি কাছিরও ওরওয়া থেকে আদৌ কোনো হাদিস শোনেননি। (দেখুন জামে তিরমিজি, ছাওম অধ্যায়, মধ্য শাবানের রাত, পৃ: ১৬৫-১৬৮)।
৩) আবু মুছা আশআরি রা: থেকে বর্ণিত : রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ১৫ শাবানের রাতে আল্লাহ তায়ালা নিচে নেমে আসেন, বরং সব মাখলুককেই মাফ করে দেন। তবে মুশরিক এবং মানুষের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টিকারীকে মাফ করেন না (ইবনে মাজাহ)। এ হাদিসটির ব্যাপারে হাফেজ শিহাবুদ্দীন তার যাওয়ায়েদে ইবনে মাজাহ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, এর সনদ জইফ (দুর্বল)। একজন রাবি (বর্ণনাকারী) আবদুল্লাহ বিন লাহইয়াআহ নির্ভরযোগ্য নন। আরেকজন রাবি ওয়ালিদ বিন মুসলিম তাদলিছকারী (সনদের মধ্যে হেরফের করতে অভ্যস্ত) হিসেবে পরিচিত। শবেবরাতে আমল করা যেতে পারে অনেক ওলামায়ে কেরাম এমন মতামত দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন আসে, আমল করতে হলে কিভাবে করা যাবে।

প্রথমত, ব্যক্তিগতভাবে কিছু ইবাদত বন্দেগি করা যেতে পারে। সে জন্য মসজিদে সমবেত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করার জন্য ওয়াজ, নসিহত, জিকির ইত্যাদির আয়োজন করা যাবে না (দেখুন : ফাতাওয়া শামিয়া, ইমাম বিন আবেদীন, পৃ: ৬৪২)।

দ্বিতীয়ত, হায়াত, মাউত, রিজিক ইত্যাদির ফায়সালা এ রাতে হয়, এটা বিশ্বাস করা যাবে না। কারণ, এসব ফায়সালা লাইলাতুল কদরে হয়, তা সুস্পষ্টভাবে কুরআন ও সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।

তৃতীয়ত, আমাদের দেশে আলোকসজ্জা ও আতশবাজির যে তামাশা করা হয়, তা সুস্পষ্ট বিদ্আত। সে ধারণা থেকেই কোনো কোনো এলাকায় এ রাতের নাম হচ্ছে বাতির রাত। এসব ধারণা ইসলামী শরিয়তে হিন্দুদের দিওয়ালি অনুষ্ঠান থেকে এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা আশরাফ আলী থানভি র:। হালুয়া-রুটি বিলিবণ্টনের কার্যক্রমও বিদআত (দেখুন : ফাতওয়া শামিয়া, ইমাম বিন আবেদীন পৃ : ৬৪২)।

চতুর্থত, নফল ইবাদতের জন্য সারারাত মসজিদে এসে জেগে থাকা রাসূল সা:-এর সুন্নাতবিরোধী। তিনি নফল ইবাদত ঘরে করতে এবং ফরজ নামাজ জামায়াতের সাথে মসজিদে আদায় করতে তাগিদ করেছেন। আর সারারাত জেগে ইবাদত করাটাও সুন্নাতবিরোধী। প্রিয় নবীজী সা: সব রাতেই কিছু অংশ ইবাদত করতেন, আর কিছু অংশ ঘুমাতেন। তাঁর জীবনে এমন কোনো রাতের খবর পাওয়া যায় না, যাতে তিনি একদম না ঘুমিয়ে সারারাত জেগে ইবাদত করেছেন।

পঞ্চমত, শবেবরাতের দিনের বেলায় রোজা রাখার হাদিস একেবারেই দুর্বল। এর ভিত্তিতে আমল করা যায় না বলে পাকিস্তানের প্রখ্যাত আলেম ও ফকিহ মুফতি মাওলানা তাকি উসমানী সাহেবের সুস্পষ্ট ফতোওয়া রয়েছে।

ষষ্ঠত, শবেবরাতের রোজার পক্ষে যেহেতু কোনো মজবুত দলিল নেই, তাই যারা নফল রোজা রাখতে চান, তারা আইয়ামে বিজের তিনটি রোজা ১৩, ১৪ ও ১৫ রাখতে পারেন। এর পক্ষে সহিহ হাদিসের দলিল রয়েছে। শুধু একটি না রেখে এ তিনটি বা তার চেয়েও বেশি রোজা রাখতে পারলে আরো ভালো। কারণ, শাবান মাসে রাসূলুল্লাহ সা: সবচেয়ে বেশি পরিমাণ নফল রোজা রেখেছেন।

Wednesday, June 6, 2012

শাইখ আহমদের স্বপ্ন বা একটি ‘জরুরী বার্তা’ফটোকপি করে বিতরণ সঠিক তথ্য উদ্ঘাটন



একটি জরু€রী বার্তানামে একটি বিজ্ঞাপন বহুদিন থেকে মুসলিম সমাজে প্রচারিত হয়ে আসছে। বিজ্ঞাপনটির বিষয় বস্তু হল- মদীনা মুনাওয়ারার অজ্ঞাত পরিচয় জনৈক শাইখ আহমদের স্বপ্ন যোগে প্রাপ্ত একটি অছিয়ত নামা
দুর্বল ঈমানের কিছু সংখ্যক মুসলমান এতে বিশ্বাস করে ভয়-ভীতি ও আশা-আকাখা সহকারে উক্ত অছিয়ত নামাছাপিয়েছে বা ফটো কপি করে তা সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক হারে বিলি করেছে এবং করছে। কেননা উক্ত অছিয়ত নামা সরাসরি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লাম) থেকে প্রাপ্ত বলে দাবী করা হয়েছে। অছিয়তে রাসুলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
যে ব্যক্তি এই অছিয়ত নামা ছাপিয়ে মানুষের মাঝে বিতরণ করবে সে আমার শাফআত পাবে, জান্নাতের অধিবাসী হবে, ব্যবসায় প্রচুর লাভবান হবে, ঋণ গ্রস্থ ব্যক্তি ঋণ মুক্ত হবে। অপরদিকে এটাকে ছাপাতে গড়িমসি করলে তার মৃত্যু হবে, অবিশ্বাস করলে কাফের হয়ে যাবে, আল্লাহ্‌র রহমত থেকে বঞ্চিত হবে, আমার শাফাআত থেকে মাহর€ম হবে।শাইখ আহমদ আল্লাহ্‌র নামে শপথ করে বলেন এটি যদি মিথ্যা হয় তবে তার মৃত্যু যেন কাফেরের মৃত্যু হয় .. .. .. ইত্যাদি।
প্রকৃত পক্ষে এটি একটি মিথ্যা, জাল ও বানোয়াট অছিয়ত নামা। উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে সাধারণ মানুষের ঈমান আকিদাকে ধ্বংস করার জন্য এটা প্রস্তুত করা হয়েছে। এর সাথে ইসলাম তথা কুরআন-হাদীসের দূরতমও কোন সম্পর্ক নেই। এর মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লাম) এর উপর সম্পূর্ণ রূপে মিথ্যা রোপ করা হয়েছে। অথচ তিনি এরশাদ করেন:
যে ব্যক্তি ইŽছাকৃত ভাবে আমার উপর মিথ্যা রোপ করে সে যেন নিজ বাসস্থান জাহান্নামে নির্দিষ্ট করে নেয়। (বুখারী, মুসলিম)
ইসলাম সম্পর্কে সামান্য জ্ঞানের অধিকারী একজন সাধারণ বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি উক্ত অছিয়ত নামা সামান্য খেয়াল সহকারে পাঠ করলেই তার মিথ্যাবাদীতা স্পষ্টভাবে ধরতে পারবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে বেশ কিছু সংখ্যক সরলমনা মানুষ উক্ত মিথ্যা অছিয়ত নামার স্বীকার হয়ে নিজেদের দূর্বল ঈমানের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তাই তাদের ঈমানকে তরতাজা করার জন্য উক্ত বিষয়ের পর্দা উন্মোচন করা সমীচীন মনে করছি।
আল্লাহ্‌ তাআলা উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য ইসলাম ধর্মকে একমাত্র জীবন ব্যবস্থা রূপে মনোনীত করেছেন। উহার প্রতিটি স্তরকে পর্ণতা দিয়েছেন। এবং তাঁর রাসুল মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লাম) সে ইসলামকে ২৩ বছরের জীবনে পরিপূর্ণ রূপে বাস্তবায়িত করেছেন। অতঃপর স্বীয় উম্মতকে স্বŽছ ও স্পষ্ট দলীলের উপর রেখে গিয়েছেন, যার রাত ও দিন বরাবর। এর মধ্যে গোপনীয়তা বা রাখ ঢাক বলতে কিছু নেই। এরশাদ হচ্ছে:
(اليوم أكملت لكم دينكم وأتممت عليكم نعمتي ورضيت لكم الإسلام ديناً )
আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জীবন ব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম।” (সূরা মায়েদাহ্‌ ৩)
চৌদ্দ শত বছর পরে এই অজ্ঞাত অছিয়ত নামায় এমন উদ্ভট দাবী করা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি উহা নিজে পড়ে অপরকে পড়তে দিবে সে তার জায়গা জান্নাতে করে নিবে, আর যে এর বিপরীত বলবে সে রাসুলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লাম) এর শাফাআত বঞ্চিত হবে। যেন ইহা পবিত্র কুরআনের চাইতে উত্তম এবং মর্যাদা পূর্ণ। এ কথাটি মিথ্যা হওয়ার জন্য এ জ্ঞানটুকুই যথেষ্ট যে, কেহ যদি পবিত্র কুরআন নিজে পাঠ করে এবং অপরকে পড়তে দেয় বা উহার হাজার হাজার কপি মানুষের মাঝে বিতরণ করে তবু সে জান্নাত তো দরের কথা জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত উহার প্রতি ঈমান এনে সে অনুযায়ী আমল না করবে। এমনি ভাবে কেহ এর (কুরআনের) প্রতি ঈমান রেখে শরীয়তের অনুসারী হওয়ার পর উহার কোন কপি যদি বিতরণ নাও করে বা অপরকে পড়ে না শোনায় তবুও তো সে কিয়ামত দিবসে রাসুলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লাম) এর শাফাআত থেকে বঞ্চিত হবে না।
সুতরাং এই একটি মিথ্যা কথাই সন্দেহহীন ভাবে সমপর্ণ অছিয়ত নামাটি বানোয়াট এবং উহার লিখক পথভ্রষ্ট হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। যদিও লিখক তার সত্যতার জন্য হাজার বার শপথ করে না কেন। কেননা ইবলিসও মিথ্যা শপথ করে আমাদের পিতা-মাতা আদম-হাওয়া(আঃ)কে জান্নাত থেকে বের করেছিল।
তাছাড়া এই অছিয়ত নামা মিথ্যা হওয়ার আরও কয়েকটি প্রমাণ হল: শেখ আহমদের দাবী মোতাবেক রাসুলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লাম) তাকে এক সপ্তাহের মধ্যে ৭ হাজার লোক কাফের অবস্থায় মারা যাওয়ার সংবাদ দিয়েছেন। এ সংবাদটি অদৃশ্য বিষয় সংক্রান্ত আর সন্দেহাতীত ভাবে তাঁর(সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লাম) ওফাতের পর অদৃশ্য বিষয়ে কোন সংবাদ সমপর্ণ রূপে বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং এটা কিভাবে সম্ভব যে তিনি মৃত্যুর পর গায়েব সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন ? অথচ জীবদ্দশাতেই এরূপ দাবী তিনি কখনো করেন নি? আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন:
( قل لا أقول لكم عندي خزائن الله و لا أعلم الغيب )
বলুন (হে রাসুল) আমি দাবী করি না যে আমার কাছে আল্লাহ্‌র ভাণ্ডার রয়েছে। তাছাড়া আমি অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে কোন জ্ঞানও রাখি না।” (সরা আনআম ৫০)
তিনি আরও বলেন:
( قل لا يعلم من في السماوات والأرض الغيب إلا الله)
বলুন (হে নবী) নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে আল্লাহ্‌ ব্যতীত কেউ গায়েবের কোন খবর জানে না।” (সূরা নমল -৬৫)
অছিয়ত নামায় আরও বলা হয়েছে: এটি ছাপিয়ে বিতরণ করলে- ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি ঋণ মুক্ত হবে, ব্যবসায় প্রচুর লাভবান হওয়া যাবে। এটিও একটি কল্পিত কথা। কেননা উক্ত উদ্দেশ্যে পবিত্র কুরআন ছাপিয়ে বিলি করলেও তা পূর্ণ হবে এ রকম কোন নিশ্চয়তা নেই। আসলে এ ব্যক্তি সাধারণ মানুষকে আল্লাহ্‌ বিমখ করার জন্য এ ধরনের পন্থা অবলম্বন করেছে। একমাত্র আল্লাহ্‌ই যে সকল কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক, যাবতীয় অভাব মোচন কারী, ঋণমুক্ত কারী, আরোগ্য দানকারী তথা সকল ক্ষমতার অধিকারী কোন কিছু চাইতে হলে বা আশা করলে যে একমাত্র তাঁর দরবারেই তা করতে হবে এই বিশ্বাসকে বিনষ্ট করার জন্য উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে উক্ত বানোয়াট অছিয়ত নামার অবতারণা করেছে। আমরা ধোঁকাবাজি ও শয়তানের ষড়যন্ত্র থেকে আল্লাহ্‌র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
অছিয়ত নামায় বলা হয়েছে: এটা ৩০ খানা ছাপিয়ে বিতরণ করলে ১৪দিনের মধ্যে ফল পাওয়া যাবে। আর ছাপাতে গড়িমসি করলে তার মৃত্যু হবে। নাউযুবিল্লাহ্‌কুরআন-হাদীস সম্পর্কেও তো এরূপ কোন কথা বলা হয়নি? এর চাইতে বড় ধোঁকাবাজি আর কি হতে পারে ! কেননা অসংখ্য মানুষ এটা ছাপিয়ে বিলি করেছে, কিনকারো কোন উপকার হয়েছে, এরকম কোন প্রমাণ তো পাওয়া যায় নি? আবার অসংখ্য মানুষ এটাকে সমর্থন না করে মৃত্যুবরণ করেছে তারও তো কোন সংবাদ পাওয়া যায় নি?
সম্মানিত পাঠক! আমরা আল্লাহ্‌কে সাক্ষ্য রেখে বলছি -এটি সমপর্ণ মিথ্যা একটি অছিয়ত নামা। চৌদ্দ শত বছর পর পরিপূর্ণ দ্বীনের মাঝে একটি নতুন সংযোজন ছাড়া আর কিছুই নয়। এর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। বর্তমান যুগে মানুষ নানা প্রকার পাপাচারে লিপ্ত -এ কথা নিঃসন্দেহে সত্য। পাপাচার পরিত্যাগ করার জন্য কুরআন ও হাদীসে বহু আলোচনা হয়েছে। নামায-রোজা তথা সকল প্রকার ইবাদত সঠিকভাবে আদায়ের ব্যাপারে পূর্ণ তাগিদ এসেছে। সুতরাং মানুষের হেদায়াতের জন্য কুরআন-হাদীস কি যথেষ্ট নয়, যে এ ধরনের মিথ্যা একটি অছিয়ত নামার মাধ্যমে মানুষকে হেদায়েত করতে হবে?
পরিশেষে সকল মুসলমানের নিকট আমাদের আবেদন- আসুন! জীবনের সকল ক্ষেত্রে এক আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণ রূপে আত্মসমর্পণ করি। যাবতীয় প্রার্থনা তাঁর কাছেই নিবেদন করি। সব কিছু পরিত্যাগ করে কুরআন-হাদীস আঁকড়ে ধরি। আল্লাহ্‌ এবং ত্বদীয় রাসুলের হেদায়েতকে সর্বোŽচ্চ সম্মান দেই। আর ইসলামের শত্রুদের ষড়যন্ত্রকে বানচাল করার জন্য সঠিক ইসলামী শিক্ষা অর্জন করে ঈমানকে মজবুত করি।
হে আল্লাহ্‌! তুমি মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা সার্বিক উন্নতি দাও। তাদেরকে হক পথে পরিচালিত কর। এবং সকল প্রকার পাপাচার থেকে তওবা করার তাওফিক দাও। নিশ্চয় তুমি তওবা কবুল কারী এবং সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। আমীন ॥