Wednesday, August 17, 2011

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের তাৎপর্য - ড: আবু আমিনাহ বিলাল ফিলিপস

ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ "যাকাত" এর উপর ড: আবু আমিনাহ বিলাল ফিলিপস-এর লেখার অংশটুকু আমি পাইনি। সে বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ইনশাল্লাহ! - রফিকুল হাসান শরীফ

[বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। মানবজাতির জন্য মানবজাতির স্রষ্টা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার মনোনীত জীবন ব্যবস্থা হচ্ছে ইসলাম। ধর্ম সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ইসলামকে কতগুলো দৈনন্দিন কিংবা সাময়িক আচার-অনুষ্ঠানের সমষ্টি হিসেবে গণ্য করাটা ভুল হবে। বরং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রেই কিছু দিকনির্দেশনা ঠিক করে দিয়েছেন, যেগুলোর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের গোটা জীবনকে একটি সমন্বিত ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসার মাধ্যমে তাকে প্রকৃত অর্থে মানুষের আসনে অধিষ্ঠিত করা - আর আল্লাহর দেয়া এই দিকনির্দেশনার সমষ্টিই হচ্ছে ইসলাম। ইসলাম একজন মানুষের জীবনকে একই সাথে জাগতিক এবং আত্মিক দিক থেকে পূর্ণতা দান করে। ইসলাম যেমন মানুষের আত্মিক সমৃদ্ধির জন্য আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক স্থাপনের সঠিক উপায় দেখিয়ে দেয়, তেমনি তার জাগতিক মৌল সকল প্রয়োজন পূরণের জন্যও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়। যেহেতু স্রষ্টা মানুষের শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, সামাজিক পরিস্থিতি এবং অতীত, বর্তমান ভবিষ্যত সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন, সেজন্য তাঁর দেয়া এই জীবন পদ্ধতিই মানুষের পার্থিব স্বাচ্ছন্দ্য এবং আখিরাতে মুক্তির জন্য একমাত্র পথ। মানুষের চিন্তা-গবেষণা ও কল্পনাপ্রসূত অপরাপর জীবন-ব্যবস্থা যেহেতু মানুষের অপূর্ণ জ্ঞানের ফসল, অতএব তাতে ভুলত্র“টি থাকাই স্বাভাবিক, বাহ্যত সেগুলোকে ভাল মনে হলেও।

ইসলামের যে কাজগুলোকে আপাতঃ দৃষ্টিতে নিছক “আনুষ্ঠানিকতা” বলে মনে হয়, সেগুলোও মূলত উচ্চতর কিছু লক্ষ্য অর্জনের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা কর্তৃক প্রণীত। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব থাকায় মুসলিম জীবনে এসব কাজের কাঙ্খিত ফল দেখতে পাওয়া যায় না। ফলশ্র“তিতে আমরা মুসলিম সমাজে এমন মানুষ দেখতে পাই, যারা নামায রোযা প্রভৃতি ইসলামের মৌল বিধানগুলো বাহ্যতঃ পালন করলেও তাদের জীবনে ইসলামের সার্বিক শিক্ষার প্রতিফলন নেই। অনেক সময় মুসলিমদেরকে দেখা যায় বড় বড় অন্যায় কাজে ডুবে থাকতে। ইসলামে ইবাদতের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে অনবহিত থাকার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ইসলামের মূল বিধানগুলোর কাঙ্খিত প্রভাব মুসলিমের জীবনে দেখা যায় না। যেমন আমরা জানি যে ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এই পাঁচটি ভিত্তিই ইসলামের শেষকথা নয়, এ ভিত্তিগুলোর প্রতিটিই আল্লাহ কর্তৃক প্রণীত হয়েছে মানুষের আত্মিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে ক্রমান্বয়ে তাকে ইসলামের পূর্ণ ব্যবস্থাকে জীবনে বাস্তবায়ন ও ধারণ করার প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে। আর এ বিষয়টিই এই নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচিত হবে ইনশা আল্লাহ। - অনুবাদক ]
****************************************************************************************************************

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের তাৎপর্য - ড: আবু আমিনাহ বিলাল ফিলিপস

ইসলামের শিক্ষা পাঁচটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। “হাদীস জিবরীল” নামে সুপরিচিত হাদীস থেকে ইসলামের পাঁচটি ভিত্তি সম্পর্কে জানা যায়। আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেন যে একদিন তাঁরা (সাহাবীগণ) রাসূলুল্লাহ (সা) এর সাথে উপবিষ্ট ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁদের উদ্দেশ্যে বললেন:

“আমাকে যেকোন কিছু সম্পর্কে প্রশ্ন কর।” কিন্তু তাঁরা গভীর শ্রদ্ধাবোধের কারণে তাঁকে কোন প্রশ্ন করা থেকে বিরত রইলেন। উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বর্ণনা করেন, “যখন আমরা রাসূলুল্লাহ (সা) এর সাথে বসে ছিলাম, একজন ব্যক্তি আমাদের মাঝে উপস্থিত হলেন যার পোশাক ছিল অত্যধিক শুভ্র এবং চুল ছিল ঘন কালো। তার মাঝে ভ্রমণের কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল না, আমরা কেউ তাকে চিনতাম না। তিনি হেঁটে এসে নবীর (সা) পাশে বসলেন। তাঁর হাঁটুতে হাঁটু লাগিয়ে এবং নিজের হাত তাঁর উরুতে রেখে বললেন: ‘হে মুহাম্মাদ, আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলুন।’ আল্লাহর রাসূল (সা) বললেন: ‘ইসলাম হচ্ছে এই সাক্ষ্য দেয়া যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল, সালাত আদায় করা, যাকাত দেয়া, রমযানে রোযা রাখা এবং সামর্থ্য থাকলে (আল্লাহর) গৃহে হাজ্জ পালন করা। তিনি বললেন: ‘আপনি সত্য বলেছেন।’ এবং আমরা চমৎকৃত হলাম তার প্রশ্ন করা এবং এ কথা বলা দেখে যে তিনি (রাসূলুল্লাহ (সা)) সত্য বলেছেন। তিনি বললেন: ‘আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন। তিনি (সা) বললেন: ‘এটা হচ্ছে আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতামন্ডলী, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ, আখিরাত এবং ভাল ও মন্দের নির্ধারণের (ভাগ্য) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।’ তিনি বললেন: ‘আপনি সত্য বলেছেন’। তিনি বললেন: ‘এবার আমাকে ইহসান সম্পর্কে বলুন।’ তিনি (সা) বললেন: ‘এ হল আল্লাহকে এমনভাবে ইবাদত করা, যেন তুমি তাঁকে দেখছ, এবং যদিও বা তুমি তাঁকে দেখতে পাও না, তথাপি তিনি অবশ্যই তোমাকে দেখছেন।’ তিনি বললেন: ‘এবারে আমাকে কাল (বিচার দিবস বা কিয়ামত) সম্পর্কে বলুন।’ তিনি (সা) বললেন: ‘প্রশ্নকৃত ব্যক্তি প্রশ্নকারী অপেক্ষা এ সম্পর্কে অধিক কিছু জানে না।’
তিনি বললেন: ‘তাহলে আমাকে এর লক্ষণসমূহ সম্পর্কে কিছু বলুন।’ তিনি (সা) বললেন: ‘দাসী তার মনিবকে জন্ম দেবে [এর একাধিক ব্যাখ্যা সম্ভব, একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে সন্তানেরা তাদের জন্মদাত্রীর সাথে দাস-দাসীর ন্যয় আচরণ করবে], এবং তুমি দেখবে নগ্নপদ, বিবস্ত্র, দরিদ্র রাখালেরা সুউচ্চ দালান তৈরীর প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে।’ এরপর তিনি চলে গেলেন এবং আমি আরও কিছুক্ষণ বসে রইলাম। তারপর তিনি (সা) বললেন: ‘হে উমার, তুমি কি জান এই প্রশ্নকারী কে ছিলেন?’ আমি বললাম: ‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ভাল জানেন।’ তিনি (সা) বললেন: ‘ইনি ছিলেন জিবরীল, তিনি তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শিক্ষা দিতে এসেছিলেন।’ ”

এই একটি হাদীসে ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক শিক্ষা নিহিত রয়েছে। বর্তমান নিবন্ধে আমরা আমাদের আলোচনা কেবল ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভেই সীমাবদ্ধ রাখব।

১. ইসলামের প্রথম স্তম্ভ: শাহাদাতান (দুটি সাক্ষ্য)

ইসলামের প্রথম স্তম্ভ হচ্ছে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” যার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে “আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল”। যদিও এর প্রথম অংশের আক্ষরিক অর্থ “আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই”, প্রকৃতপক্ষে বিশ্বে আল্লাহর পাশাপাশি বহু ইলাহ বা দেবতার উপাসনা হয়ে আসছে। প্রতিটি ধর্মেই নিজস্ব দেবতা রয়েছে, কিন্তু ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী এ সবই নকল দেবতা। তাই এই সাক্ষ্যের প্রথম অংশে আল্লাহর পাশাপাশি আর কোন প্রকৃত দেবতার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হচ্ছে। সেই সাথে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে যে প্রকৃত উপাস্য একজনই: আল্লাহ। এজন্য “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”র প্রকৃত ভাবার্থ হচ্ছে “আল্লাহ ছাড়া উপাসনার যোগ্য কোন কিছু নেই।”

ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, এই সাক্ষ্যই হচ্ছে মানবমুক্তির মৌল ভিত্তি, যদি জ্ঞানের ভিত্তিতে এ সাক্ষ্য দেয়া হয়। তাই উসমান (রা) রাসূলুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন: “যে কেউই এ কথা জেনে মৃত্যুবরণ করবে যে আল্লাহ ছাড়া উপাসনার যোগ্য কেউ নেই, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” কেউ যদি কেবল তার মুরুব্বীদেরকে সন্তুষ্ট করতে, কিংবা সামাজিকতা রক্ষা করতে কিংবা বিয়ের জন্য এই সাক্ষ্য মুখে উচ্চারণ করে, তবে তার পার্থিব স্বার্থ রক্ষিত হবে বটে, কিন্তু মৃত্যুর পরের জীবনে তা তার কোন কাজেই আসবে না। কোন বিধর্মী যদি কেবল কোন মুসলিমকে বিয়ে করার জন্য এই সাক্ষ্য দেয়, তবে সেই বিয়ে আল্লাহর দৃষ্টিতে বাতিল বলে গণ্য হবে (পশ্চিমা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত মুসলিমদের ক্ষেত্রে অনেক সময় এমনটি ঘটে)। যদি কোন মুসলিম মহিলা কোন অমুসলিমকে এ কথা জেনে বিয়ে করে যে সে কেবল বিয়ের জন্য এই সাক্ষ্য দিচ্ছে, তবে ইসলামের দৃষ্টিতে এই মহিলা যিনাকারী হবে। অপরপক্ষে কেউ যদি এই সাক্ষ্য দেয়, তবে তাকে মুসলিম বলেই গণ্য করতে হবে যতক্ষণ না তার কথা বা কাজে এর বিপরীত কিছু প্রকাশিত হয়। রাসূলুল্লাহর (সা) সাহাবী উসামাহ ইবন যায়িদ (রা) একটি সংঘর্ষে একজন কাফিরকে হত্যা করার সময় সেই লোকটি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলল, কিন্তু সে মৃত্যুর ভয়ে এ কথা বলেছে মনে করে উসামাহ (রা) তাকে হত্যা করলেন। পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে এ ঘটনা বর্ণনা করা হলে তিনি প্রশ্ন করলেন: “সে আল্লাহ ছাড়া উপাসনার যোগ্য কেউ না থাকার ঘোষণা দেয়া সত্তেও কিভাবে তুমি তাকে হত্যা করতে পারলে?” উত্তরে সাহাবী জবাব দিলেন যে সে অস্ত্রের ভয়েই একাজ করেছে। তখন নবীজী (সা) বললেন: “তুমি কি তার অন্তর চিরে দেখেছিলে যে অন্তর বিশ্বাস করেছিল কিনা?” তিনি (সা) একথা বারবার বলতে লাগলেন এবং এই সাহাবী বর্ণনা করেন যে তিনি আশা করছিলেন, যদি সেই দিনটিতে তিনি নতুন করে ইসলামে দীক্ষিত হতেন তবে কতই না ভাল হত!

এই সাক্ষ্যের দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” অর্থাৎ “মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল”। এই সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ হল, আমরা আমাদের জীবনে একমাত্র নির্ভুল আদর্শ হিসেবে মুহাম্মাদ (সা) কে গ্রহণ করলাম। অর্থাৎ তাঁর সকল আদেশ আমরা মেনে চলব, তাঁর কোন আদেশের মাঝে কি কল্যাণ নিহিত আছে সেটা বোঝা না গেলেও। এই প্রশ্নাতীত আনুগত্য কেবল মুহাম্মাদ (সা) এর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, কেননা তাঁর প্রতিটি আদেশ ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত, তিনি নিজের খেয়াল কিংবা ধারণার বশবর্তী হয়ে কোন কথা বলেন নি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা স্বয়ং তা তুলে ধরেছেন:

“তিনি নিজে থেকে কোন কথা বলেন না, (তিনি যা বলেন তা) কেবলই ওহী যা তার নিকট প্রেরিত হয়।” (সূরা আন নাজম, ৫৫ : ৩-৪)

তাই নবীজীর (সা) আনুগত্য করা মানেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার আনুগত্য করা:

“যে রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল।” (সূরা আন নিসা, ৪ : ৮০)

এছাড়া অন্য যে কারও আনুগত্য আপেক্ষিক। নবীজী (সা) বলেছেন: “সৃষ্টিকর্তার অবাধ্যতা করে কারও আনুগত্য নেই।”

মুহাম্মাদের (সা) নবুওয়্যত স্বীকার করা অর্থ তাঁকে শেষ নবী হিসেবেও স্বীকৃত দেয়া। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনে ঘোষণা দিচ্ছেন:

“মুহাম্মাদ তোমাদের মাঝে কোন পুরুষের পিতা নন, বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং নবীগণের মোহর।” (সূরা আল আহযাব, ৩৩ : ৪০)

এছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: “আমার এবং পূর্ববর্তী নবীগণের তুলনা হচ্ছে এমন যে এক ব্যক্তি একটি চমৎকার ও সুদৃশ্য বাসা তৈরী করল, কিন্তু এক কোণায় একটি ইট ছাড়া। লোকেরা এই দালানের চারপাশে ঘুরে ঘুরে এর প্রশংসা করছে আর বলছে, ‘ওখানে ইটটি বসানো হল না কেন?’ আমিই সেই ইট এবং সকল নবীদের শেষ নবী।”

এ দুটি সাক্ষ্য দিতে হবে প্রকাশ্যে, যদি না কারও জীবনের ভয় থাকে। যেমন ইথিওপিয়ার শাসক নাজ্জাশী যিনি সেখানে হিজরত করে যাওয়া মুসলিমদের প্রথম দলটিকে আশ্রয় দেন, তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রেখেছিলেন। এই প্রকাশ্যে ঘোষণার উদ্দেশ্য আল্লাহকে জানানো নয়, কেননা তিনি মানুষের অন্তরের কথা জানেন। বরং এটা এজন্য যে মুসলিম সমাজ যেন ইসলাম গ্রহণকারীর ধর্মান্তরিত হওয়ার কথা জানতে পারে, ফলে সে মুসলিম সমাজের পক্ষ থেকে সহযোগিতা এবং নিরাপত্তা লাভ করতে পারবে। ধর্মান্তরিত ব্যক্তি যদি মুসলিম সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে, তবে শয়তানের কুপ্ররোচনা এবং ইসলাম বিরোধী শক্তির প্রচেষ্টায় তার ইসলাম ত্যাগের সম্ভাবনা থেকে যায়। সে জন্য নবীজী (সা) মুমিনদেরকে মুসলিম সমাজকে আঁকড়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এবং আল্লাহ সতর্ক করেছেন, যারা মুসলিম সমাজের পথ থেকে বিচ্যুত হবে, তাদের গন্তব্য হবে জাহান্নামে।

বর্তমান মুসলিম সংস্কৃতিতে শাহাদাতান: “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” এই সাক্ষ্যদ্বয়ের গুরুত্বের উপলব্ধি না থাকায় প্রচলিত মুসলিম সংস্কৃতিতে দেখা যায় সুন্দর ক্যালিগ্রাফিতে লেখা অবস্থায় এই সাক্ষ্যদ্বয় ড্রইংরুমের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। শিশুরা কথা বলতে শেখার সাথে সাথেই তাদেরকে এই “কলেমা” মুখস্থ করিয়ে দেয়া হয়। এছাড়াও প্রতি আযানে এবং প্রতি নামাযের তাশাহহুদে আমরা এই সাক্ষ্য দিয়ে থাকি। কিন্তু তা সত্ত্বেও মুসলিমের জীবনে এর কোন প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় না, কেননা বহু মুসলিমই এই ভুল ধারণার শিকার যে মুসলিম পরিবারে জন্ম নিলে এবং ‘মুসলিম’ নামধারী হলেই জান্নাতের নিশ্চয়তা রয়েছে, তারা জীবনে যেরকম কাজই করুক না কেন! এ বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, কেননা রাসূলুল্লাহ (সা) স্পষ্টতঃ তাঁর সাহাবী উমার ইবনুল খাত্তাবকে (রা) বলেছেন মানুষকে যেন জানিয়ে দেয়া হয় যে কেবল প্রকৃত ঈমানদারেরাই জান্নাতে প্রবেশ করবে।

একজন মুসলিমের চরিত্রে শাহাদাতানের কাঙ্খিত প্রভাব:

  • ক. উন্মুক্ত চরিত্র: মুমিনরা কখনও গোপনীয়তায় বিশ্বাসী নয়। তারা সবসময় গোপন সংগঠনকে এড়িয়ে চলবে, কেননা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সমাজে এধরনের সংগঠনের প্রভাব হয় খারাপ। আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা এ ধরনের গোপনীয়তাকে নিরুৎসাহিত করে বলেছেন:

    “তাদের অধিকাংশ গোপন বৈঠকেই কোন কল্যাণ নেই কেবল তারা ছাড়া, যারা দান, সত্যনিষ্ঠা এবং মানুষের মাঝে সৌহার্দ সৃষ্টিকে উৎসাহিত করার জন্য মিলিত হয়, যেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তা করবে, আমি তাকে বিরাট প্রতিদান দেব।” (সূরা আন নিসা, ৪ : ১১৪)

    গুপ্ত ভ্রাতৃসংঘ (ফ্রি মেসন) জাতীয় গোপন সংগঠনগুলো জনগণের আস্থা অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যে কিছু সেবামূলক কাজ করলেও প্রাথমিকভাবে তারা তাদের সদস্যদের স্বার্থে কাজ করে। তারা অন্যায়কারী হলেও সংগঠন তাদের রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়। রাসূলুল্লাহ (সা) গোপনীয়তাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য বলেছেন “তিনজন উপস্থিত থাকলে কোন দুজনের উচিৎ নয় অপরজনকে বাদ দিয়ে গোপনে কথাবার্তা বলা।”

  • খ. সৎ চরিত্র: মুমিনরা তাদের মানুষের সাথে তাদের লেনদেনের ক্ষেত্রে সৎ। তারা মানুষের প্রতি অন্তরে ঘৃণা পোষণ করে রেখে সম্মুখে তাদেরকে হাসিমুখ উপহার দেবে না। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “কিয়ামতের দিন আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোক হবে দ্বিমুখী লোকেরা, যারা একদল লোকের সামনে এক চেহারা, আরেক দল লোকের সামনে আরেক চেহারা নিয়ে হাজির হয়।”
  • গ. ইসলামের দিকে আহবানকারী চরিত্র: যে ইসলাম গ্রহণ করেছে, সে যদি সত্যিই বিশ্বাস করে যে ইসলামই মানবজাতির মুক্তির একমাত্র পথ, সে অন্যদেরকে এ কথা জানাতে মোটেই দ্বিধা করবে না। একজন মুসলিম কখনোই তার অমুসলিম কোন প্রতিবেশী বা সহকর্মীর সাথে চুপচাপ তাকে ইসলাম সম্পর্কে কিছু না জানিয়ে সহঅবস্থান করে যেতে পারে না। কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মুমিনদেরকে ইসলামের বাণী পৌঁছানোর আহবান জানিয়ে বলছেন:

    “তোমার রবের পথে ডাক, বিজ্ঞতা এবং উত্তম কথার সাহায্যে।” (সূরা আন নাহল, ১৬ : ১২৫)

    রাসূলুল্লাহ (সা) ব্যাখ্যা করেছেন যে এই দায়িত্ব কেবল পণ্ডিতগণের নয়, যারই কিছুটা জ্ঞান আছে, তার ওপরই এই দায়িত্ব বর্তায়। তিনি বলেছেন: “আমার কাছ থেকে যা কিছুই শিখেছ, তা প্রচার কর যদি তা কুরআনের একটি আয়াতও হয়।” এরূপ উপকারী জ্ঞান গোপন করা ইসলামের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ধর্মীয় জ্ঞান গোপনকারীদেরকে তিরস্কার করেছেন এভাবে:

    “নিশ্চয়ই আমি কিতাবে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়ার পরও যারা আমার নাযিল করা সুস্পষ্ট প্রমাণাদি এবং দিকনির্দেশনাকে গোপন করে, তারা আল্লাহ কর্তৃক অভিশপ্ত এবং সকল অভিসম্পাতকারী কর্তৃক অভিশপ্ত।” (সূরা আল বাক্বারাহ, ২ : ১৫৯)

    রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: “যে জ্ঞান গোপন করবে, তাকে জাহান্নামের (আগুনে উত্তপ্ত) একটি দন্ড দ্বারা দাগাঙ্কিত করা হবে।”

২. ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ: সালাত

দৈনিক পাঁচবার আনুষ্ঠানিক সালাত ইসলামে বাধ্যতামূলক। মানুষ অনেক সময় তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোকে ভুলে যায়। জাগতিক প্রয়োজন মেটানোর কর্মকান্ডে মানুষ এতটাই ডুবে থাকে যে সে তার আত্মিক প্রয়োজন বিস্মৃত হয়। আর এজন্যই একজন মুমিনের জীবনকে আল্লাহর ইবাদতকে কেন্দ্র করে সাজানোর জন্য কমপক্ষে পাঁচবার সালাত তার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সাধারণতঃ একজন মানুষের জীবন তার পার্থিব প্রয়োজনকে ঘিরে সাজানো। তার ঘুম থেকে ওঠা, নাস্তা করা, দুপুরের খাবার, বিকালের চা-বিরতি, এবং রাতের ঘুম – এর প্রতিটির সময় নির্ধারণ করা হয় তার জাগতিক প্রয়োজনকে ঘিরে। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত তার জীবনকে বস্তুকেন্দ্রিক বিন্যাস থেকে স্রষ্টাকেন্দ্রিক বিন্যাসে নিয়ে আসে [উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে একজন অফিস কর্মচারীর অফিস নটায় আরম্ভ হলে সে ঘুম থেকে উঠবে সাতটা বা আটটায়, কিন্তু সে যদি মুসলিম হয়, তা’হলে তাকে দিন শুরু করতে হবে আরও ভোরে - অনুবাদক]। সালাতের মূল উদ্দেশ্য হচেছ আল্লাহকে স্মরণ করা, যেমনটি কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে:

“নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ, আমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই, সুতরাং আমার ইবাদত কর, এবং আমার স্মরণের উদ্দেশ্যে সালাত প্রতিষ্ঠা কর।” (সূরা তা হা, ২০ : ১৪)

এখানে আল্লাহর স্মরণের ওপর জোর দেয়ার কারণ হচ্ছে মানুষ আল্লাহকে যখন ভুলে যায়, তখনই সে পাপকাজে লিপ্ত হয়। আল্লাহ সম্পর্কে সচেতনতা হারিয়ে ফেললে মানুষের ওপর কুশক্তি সহজে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এভাবে শয়তানী শক্তিসমূহ মানুষের মনে অপ্রাসঙ্গিক চিন্তা ও কামনা-বাসনার জন্ম দিয়ে তাকে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিচ্যুত করে। আল্লাহকে একবার ভুলে গেলে মানুষ যেকোন অন্যায় কাজই করতে পারে। কুরআনের সূরা মুজাদালায় এই অবস্থার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে এভাবে:

“শয়তান তাদের ওপর পরাক্রমশালী হয়েছে এবং তাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিচ্যুত করেছে। ওরাই শয়তানের দল। নিশ্চয়ই শয়তানের বাহিনীই প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত।” (সূরা আল মুজাদালাহ, ৫৮ : ১৯)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর প্রদত্ত বিধানের মাধ্যমে নেশাদ্রব্য এবং জুয়া খেলাকে নিষিদ্ধ করেছেন প্রাথমিকভাবে এজন্য যে এগুলোর কারণে মানুষ আল্লাহকে সহজে ভুলে যায়। মানুষের দেহ ও মন খুব সহজেই নেশাদ্রব্য ও ভাগ্যের খেলার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। এই আসক্তি একবার অন্তরে প্রবেশ করলে বারংবার এগুলোর দ্বারা উত্তেজিত হওয়ার চাহিদা তৈরী হয় এবং এ থেকে সহজেই মানুষ বিভিন্ন ধরনের অনৈতিকতা ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সূরা আল মায়িদায় উল্লেখ করেছেন:

“শয়তানের পরিকল্পনা হচ্ছে তোমাদের মাঝে নেশাদ্রব্য এবং জুয়ার মাধ্যমে শত্র“তা ও ঘৃণার জন্ম দেয়া, এবং আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের দূরে সরিয়ে রাখা। তারপরও কি তোমরা বিরত হবে না?” (সূরা আল মায়িদাহ, ৫ : ৯১)

তাই মানবজাতির নিজের মুক্তি এবং সমৃদ্ধির জন্যই আল্লাহকে স্মরণ করা প্রয়োজন। প্রতিটি মানুষই জীবনের দুর্বল কিছু মুহূর্তে পাপকাজে জড়িয়ে পড়ে, তাদের যদি নিয়মিত আল্লাহকে স্মরণ করার কোন ব্যবস্থা না থাকে, তবে তারা আরও বেশী মাত্রায় পাপ ও অনৈতিকতায় ডুবে যেতে থাকে। কিন্তু যারা নিয়মিত সালাত আদায় করবে, তাদের কিছুক্ষণ পরপরই আল্লাহর কথা স্মরণ হবে ফলে তাদের তওবা করার এবং নিজেদেরকে শুদ্ধ করে নেয়ার সুযোগ থাকবে।

বর্তমান মুসলিম সংস্কৃতিতে সালাত: সালাতের এত গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও বহু মুসলিম একে অবহেলা করে থাকে। সালাতের ব্যাপারে মুসলিমদের মাঝে বিভিন্নমুখী অবহেলার প্রবণতা দেখা যায়। কেউ একে কেবল কিছু সওয়াব আহরণের উপায় হিসেবে দেখে, ফলে তারা বছরে দুইদিন দুই ঈদের সময় কেবল নামাযে হাজির হয়। কেউ কেউ কেবল রমযান মাসে নামায পড়ে, আবার কেউ কেউ কেবল জুমুআর নামায পড়ে থাকে। কেউ কেউ নিয়মিতভাবে এক বা একাধিক ওয়াক্তের নামায বাদ দিয়ে থাকে (যেমন: ফজর), আবার কেউ কেউ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে একসাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে নেয়। আবার যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে দাঁড়ায়, তাদের মাঝে অনেকেই অতি দ্রুততার সাথে নামায পড়ে এবং নামাযে সে কি বলছে বা করছে, তা নিয়ে মোটেও চিন্তা করেনা। রাসূলুল্লাহ দ্রুত নামায আদায়কারীকে পুনরায় নামায পড়তে বলতেন, কেননা এরূপ দ্রুততার সাথে নামায আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।

মুসলিম সমাজে সালাতের এই অবস্থানের কারণেই মুসলিমদেরকে নামায পড়ার পাশাপাশি সকল প্রকার অনৈতিক কাজে লিপ্ত থাকতে দেখা যায়। অথচ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনে বলেছেন:

“নিশ্চয়ই সালাত অন্যায় কথা ও কর্মকে প্রতিহত করে।” (সূরা আল আনকাবুত, ২৯ : ৪৫)

তাই কারও সালাত যদি তাকে অন্যায় থেকে ফিরিয়ে না রাখে, তবে বুঝতে হবে সে যথার্থভাবে সালাত আদায় করছে না।

একজন মুসলিমের চরিত্রে সালাতের কাঙ্খিত প্রভাব:

  • ক. আল্লাহ-ভীতি: সালাতের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির মনে আল্লাহ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হবে, ফলে সে প্রতিটি কাজের আগে নিজেকে প্রশ্ন করবে: “এ কাজটি কি আল্লাহর দৃষ্টিতে পছন্দনীয়?” আল্লাহ সম্পর্কে এই সচেতনতাই নৈতিকতার মূল ভিত্তি, কেননা একমাত্র এই আল্লাহ-ভীতিই একজন মানুষকে সকল অবস্থায় সকল মন্দ থেকে বিরত রাখতে পারে, এমনকি যখন আর কেউ তাকে দেখতে পায় না, তখনও।
  • খ. উত্তম-ভাষা: একজন প্রকৃত মুমিন কখনও অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ, দুর্নাম, গীবত এবং মিথ্যাচার করতে পারে না। নামাযে দাঁড়িয়ে সে কেবলই উত্তম বাক্য উচ্চারণ করে, তাই জীবনের সর্বক্ষেত্রে তার উত্তম কথা বলার অনুশীলন হয়। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস করে, সে যেন ভাল কথা বলে অথবা চুপ থাকে।”
  • গ. উত্তম-কর্ম: নামাযের মধ্যে একজন মুসলিম প্রতিটি কাজ করে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী, নিজের খেয়াল অনুযায়ী সে কিছু করেনা, নামাযে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ কিছু নির্দিষ্ট ভঙ্গীতে নাড়াতে বা স্থির রাখতে হয়, ফলে সে নামাযের মধ্যবর্তী স্থানেও আল্লাহর নির্দেশ মেনে কাজ করার শিক্ষা লাভ করে। ফলে সে যেদিকে তাকায়, যা কিছু শোনে, ধরে কিংবা যে পথে হাঁটে, তার প্রতিটিই হবে উত্তম। তেমনি মানুষের সাথে তার আচরণ হবে মার্জিত ও সুশীল। রাসূলুল্লাহ (সা) এর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন এভাবে: “দ্বীন হচ্ছে উত্তম সামাজিক আচরণের সমষ্টি।”
৪. ইসলামের চতুর্থ স্তম্ভ: সাওম

রামাদানের গুরুত্ব: রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “রামাদানের আগমনে জান্নাতের দরজাগুলোকে খুলে দেয়া হয়।” প্রচুর পরিমাণে ভাল কাজ করে জান্নাতের নিকটবর্তী হওয়ার বিরাট সুযোগ আসে রামাদানে।

রামাদানে সিয়াম পালনের মাধ্যমে পূর্ববর্তী গুনাহ মাফ করিয়ে নেয়ার চমৎকার সুযোগ আসে। আবু হুরায়রা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে উদ্ধৃত করেছেন: “যে রামাদানে বিশুদ্ধ বিশ্বাসের সাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান লাভের আশায় সিয়াম পালন করবে, আল্লাহ তার পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন।”

বিশুদ্ধ নিয়তে সিয়াম পালন করলে মন্দের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার আত্মিক শক্তি অর্জিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: “রোযা ঢাল স্বরূপ।”

একান্তভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার জন্য রোযা পালনকারীর জন্য বিশেষ পুরস্কার রয়েছে। একটি হাদীসে কুদসীতে এসেছে আল্লাহ বলেন: “আদম সন্তানের সকল কাজই তার নিজের জন্য, সিয়াম ব্যতীত। এটা শুধুই আমার জন্য, এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব।”

রামাদানের এইরূপ মর্যাদার কারণ সম্ভবতঃ এই যে এই মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে, যা স্রষ্টার পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বশেষ এবং পৃথিবীতে বিদ্যমান একমাত্র অপরিবর্তিত কিতাব। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন:

“রামাদান মাস সেই মাস, যে মাসে মানবজাতির জন্য পথনির্দেশ স্বরূপ কুরআন নাযিল করা হয়েছে। এতে রয়েছে সত্য পথ প্রদর্শনের জন্য বিশুদ্ধ শিক্ষা এবং (সত্য থেকে মিথ্যাকে পার্থক্য করার) মানদন্ড।” (সূরা আল বাক্বারাহ, ২ : ১৮৫)

কুরআন নাযিল মানবজাতির প্রতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সর্ববৃহৎ অনুগ্রহ, যে মানবজাতি এর পূর্ববর্তী ওহী নাযিল হওয়ার পরবর্তী সময় থেকে নিয়ে অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল। তাঁর দয়া নিঃসৃত এই অনুপম অনুগ্রহ ছাড়া হেদায়েতের স্তিমিত-প্রায় আলোটুকুও হারিয়ে যেত এবং গোটা মানবসমাজে প্রতিষ্ঠা হত অন্যায়ের রাজত্ব।

সিয়ামের উদ্দেশ্য: রোযার মূল লক্ষ্য তাকওয়া (আল্লাহ-ভীতি এবং তাঁর সম্পর্কে সচেতনতা) অর্জন। যেমনটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনুল কারীমে উল্লেখ করেছেন:

“…যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।” (সূরা আল বাক্বারাহ, ২ : ১৮৩)

তাকওয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ নৈতিক গুণগুলোর একটি, তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে একজন মুসলিম আল্লাহর ক্রোধ এবং নিজের মাঝে একটি ঢাল তৈরী করতে পারে। তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহর সমস্ত আদেশ-নিষেধ সম্পর্কে সর্বদা সচেতন থাকা, অর্থাৎ হারাম পরিহার করা, মাকরূহ পরিহার করা এবং এমনকি সন্দেহের অবস্থায় হালালও পরিত্যাগ করা।

বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরা এটাও পরীক্ষা করে দেখেছেন যে রোযা বহুভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। যেমন এ সময় শরীরে সঞ্চিত অতিরিক্ত কোলেস্টেরল ব্যবহৃত হয়। এভাবে রোযা শরীরকে সবল রাখে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।

বর্তমান মুসলিম সংস্কৃতিতে রোযা: দুঃখজনকভাবে বর্তমান মুসলিম সংস্কৃতিতে রোযা ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনা এবং সংযমের পরিবর্তে পরিণত হয়েছে উৎসবের মাসে! রামাদানের রাতগুলি পরিণত হয় পার্টি এবং ভোজের রাত্রিতে যা কিনা কোন কোন দেশে ভোর পর্যন্ত চলে। সেখানে রাত পরিবর্তিত হয় দিনে, দিন পরিবর্তিত হয় রাতে (বহু মানুষই রোযার সময়টুকু ঘুমিয়ে কাটায়)। সাধারণতঃ সেহেরীতে মানুষ হালকা খাবারের বদলে পেট ভরে খায়। ফলে রোযা অবস্থায় খুব কম মানুষই প্রকৃত ক্ষুধার তাড়না বোধ করে। আবার ইফতারীতে আরেক দফা ভরপেট খাওয়া চলে, সেই সাথে রয়েছে রকমারী খাবারের আয়োজন। ফলে অনেকেই রামাদান শেষে ওজন বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ করে!

মুসলিম চরিত্রে সাওমের কাঙ্খিত প্রভাব:

  • ক. নিয়ন্ত্রণ: রোযা যেহেতু খাদ্য, পানীয় এবং যৌনাচার থেকে সংযম, তাই এর মাধ্যমে রোযাদারের আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুশীলন হয়। প্রকৃতপক্ষে রোযার শিক্ষা অর্জিত হয়েছে কিনা, তা বোঝার মুহূর্তটি হচ্ছে রোযা ভাঙ্গার মুহূর্ত। কেননা এসময় টেবিলে যাবতীয় মজাদার খাবার সাজানো থাকে, তাই রোযা ভেঙ্গেই মুখে প্রচুর পরিমাণে খাবার পোরার ইচ্ছে হয়, কিন্তু একজন মুমিনকে এসময় সংযত থাকতে হবে এবং নামাযের আগে হালকা কিছু মুখে দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) তিনটি খেজুর এবং পানি দিয়ে রোযা ভাঙতেন, এবং মাগরিবের নামাযের পর, মাঝারি খাবার খেতেন। আত্মিক সংযমও রোযার লক্ষ্য। কেবল খাদ্য, পানীয় ইত্যাদিই নয়, রোযাদারকে মিথ্যা বলা, গীবত করা, দুর্নাম করা ইত্যাদি থেকেও বেঁচে থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: “যে রোযা অবস্থায় মিথ্যা বলা এবং মিথ্যার ওপর আচরণ করা থেকে বিরত হল না, তার ক্ষুধা এবং তৃষ্ণায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।” তিনি (সা) আরও বলেছেন: “তোমাদের কেউ রোযা অবস্থায় যেন অশ্লীল কাজ ও অপ্রয়োজনীয় কথা থেকে বিরত থাকে, এবং যদি কেউ কোন অশ্লীল কথা শুরু করে কিংবা তর্ক করতে আসে, তবে সে যেন তাকে বলে: ‘আমি রোযাদার।’” তাই উপরোক্ত দিক নির্দেশনা মেনে যে রোযা রাখবে, তার নৈতিক চরিত্রে উন্নতি ঘটবে, সে অধিকতর সত্যবাদী এবং কথা ও কাজে আরও সতর্ক হবে।
  • খ. মধ্যপন্থা: যেহেতু রোযা ভাঙার সময় একজন রোযাদার নিজেকে সংযত রাখে, ফলে তার খাদ্যাভাসে মধ্যপন্থা গড়ে ওঠে, যেমনটি রাসূলুল্লাহ (সা) খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কে বলেছেন: “মুমিন এক পেটে, কাফির (যেন) সাত পেটে খায়।” জাবির (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে বর্ণনা করেন, “একজনের খাদ্য দুইজনের জন্য যথেষ্ট, দুইজনের খাদ্য চারজনের জন্য যথেষ্ট।” ইবন উমার (রা) বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (সা) কাউকে সঙ্গীর অনুমতি ব্যতীত খাওয়ার সময় একেকবারে দুটো করে খেজুর নিতে নিষেধ করেছেন।
  • গ. সহমর্মিতা: রোযা একজন মানুষকে ক্ষুধা এবং তৃষ্ণার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করায়, ফলে সে দরিদ্রের অবস্থা বুঝতে পারে। এর ফলে তার মাঝে দরিদ্রেকে সহায়তা করার এবং তাদেরকে নিজ সম্পদের ভাগ দেয়ার প্রেরণা সৃষ্টি হয়। আর এই চেতনার নমুনা হিসেবেই ঈদুল ফিতরের দিনে অভাবীকে নির্দিষ্ট পরিমাণে দান করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

৫. ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ: হাজ্জ্ব

সাধারণতঃ মানুষ দুটি কারণে ভ্রমণ করে থাকে। এক হচ্ছে অর্থ উপার্জনের জন্য, আরেক হচ্ছে বিনোদনের জন্য। এ দুধরনের ভ্রমণই পার্থিব স্বার্থ কেন্দ্রিক। কিন্তু হাজ্জ্ব এ দুই প্রকার ভ্রমণ অপেক্ষা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটা একান্তভাবে আল্লাহর আদেশ পালনের নিমিত্ত করা হয়। বিশুদ্ধ নিয়ত নিয়ে এই ভ্রমণে বের হওয়া তার পক্ষেই কেবল সম্ভব যে সত্যিই আল্লাহকে ভালবাসে এবং ভয় করে ও হাজ্জ্বকে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত আদেশ বলে মনে করে। ফলে যেই তার পরিবার, আত্মীয়, ব্যবসাকে পেছনে ফেলে অর্থ ব্যয় করে এবং ভ্রমণের ক্লেশ সহ্য করে হাজ্জ্ব করে, সে আল্লাহর প্রতি তার প্রকৃত ভালবাসার প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করে। সে প্রমাণ করে যে সে প্রয়োজনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যেকোন অবস্থায় নিজের পরিবার ও গৃহকে ত্যাগ করতে, কষ্ট সহ্য করে স্বেচ্ছায় নিজের স্বাচ্ছন্দ্য ও সম্পদ ত্যাগ করতে প্রস্তুত।

হাজ্জ্বে দুই প্রকারের ইবাদত সমন্বিত রয়েছে, ১) শারীরিক পরিশ্রম, যেমনটি নামায ও রোযার ক্ষেত্রে করা হয়, ২) অর্থনৈতিক, যেমনটি যাকাত ও সাদকার ক্ষেত্রে করা হয়। তেমনি হাজ্জ্বের মাধ্যমে একজন মুসলিমের চরিত্রে ইখলাস (একান্তভাবে আল্লাহর জন্য সবকিছু করা), তাকওয়া, বিনয়, আনুগত্য, ত্যাগ এবং আত্মসমর্পণের নৈতিক গুণসমূহ অর্জনের অনুশীলন হয়। কা’বা ঘর তাওয়াফ করা, সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে দৌড়ান, মিনায়, আরাফা এবং মুযদালিফায় ভ্রমণ প্রভৃতি হাজ্জ্বের শারীরিক ইবাদতগুলো নামায ও রোযার শারীরিক পরিশ্রমকে ছাড়িয়ে যায়। তাই সালাত ও সাওমের মাঝে যে আত্মনিয়ন্ত্রণ, বিনম্রতা ও আনুগত্যের শিক্ষা রয়েছে, তাও হাজ্জ্বের আনুষ্ঠানিকতায়ও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তেমনি হাজ্জ্বের জন্য অর্থ ব্যয় এবং কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য অন্তরকে লোভ-লালসা এবং পৃথিবীর প্রতি আকর্ষণ থেকে মুক্ত করার আত্মিক শিক্ষা পাওয়া যায় যেমনটি নিহিত রয়েছে যাকাত ও সাদকার মাঝে।

হাজ্জ্বের সময় একজন মুসলিম বেশ কয়েক ওয়াক্ত নামায সেই পবিত্র মসজিদটিতে পড়ার সুুযোগ পায়, যার দিকে মুখ করে সে নামায আদায় করে এসেছে গোটা মুসলিম উম্মাহর পাশাপাশি। এই মসজিদে নামায আদায়ের সওয়াব অন্যান্য মসজিদ থেকে অনেক বেশী। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, মাসজিদুল হারামে একটি নামায অন্যত্র এক লক্ষ (১০০০০০) নামাযের সমতুল্য।

কিন্তু হাজ্জ্বে এর চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার রয়েছে। এর মধ্যে দুটি এমন যা প্রত্যেক মুমিনই কামনা করে থাকে: আত্মশুদ্ধি এবং জান্নাতের প্রতিশ্র“তি। এর প্রথমটি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: “যে হাজ্জ্বের মধ্যে কোন ধরনের অশোভন কিংবা অবাধ্যতামূলক কাজ না করে আল্লাহর ঘরে হাজ্জ্ব করবে, সে এমন অবস্থায় ঘরে ফিরে আসবে যেন ঐদিনই তার মা তাকে প্রসব করল (অর্থাৎ পাপমুক্ত অবস্থায় ঘরে ফিরবে)।” দ্বিতীয়টি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: “মাবরুর (আল্লাহর নিকট যা গৃহীত হয়েছে) হাজ্জ্বের প্রতিদান জান্নাতের চেয়ে কম কিছুই নয়।”

কিন্তু হাজ্জ্বের এই উপকারিতা লাভ করা খুব সহজ নয়। কেবল মাত্র হাজ্জ্বের নিয়মিত আনুষ্ঠানিকতাগুলো পালন করাই এই প্রতিদানের নিশ্চয়তা দেয় না। হাজ্জ্ব কবুল হওয়ার জন্য যিনি হাজ্জ্ব করবেন তাঁর ভিতর প্রকৃত ঈমান থেকে উৎসারিত একপ্রকার আত্মিক প্রেরণা থাকতে হবে। এর ফলে তিনি এমন স্তরে পৌঁছবেন যে হাজ্জ্বের প্রতিটি বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতার ভিতর দিয়ে তার উদ্দেশ্য হবে উচ্চতর আত্মিক গুণ অর্জনের লক্ষ্যে উপনীত হওয়া। কেবল মাত্র এরূপ প্রেরণা থাকলেই একজন মানুষ তার হাজ্জ্বকে নষ্ট করে দেয়ার মত সকল ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া থেকে বেঁচে থাকতে পারবেন। হাজ্জ্বের সময় একজন হাজ্জ্বকারী বিশ্বের উষ্ণতম স্থানে নিক্ষিপ্ত হন এবং পরিস্থিতি সামলে নেয়ার জন্য খুবই অল্প সময় পান। রকমারি সংস্কৃতি এবং স্বভাবের মানুষ পরস্পরের সান্নিধ্যে আসার ফলে সেখানে ভুল বোঝাবুঝি এবং বিরোধের সম্ভাবনা প্রবল। এছাড়া কিছু সংখ্যক মানুষের অসৎ উদ্দেশ্যে হাজ্জ্বে আসার কারণে হাজ্জ্বের সময় মানসিক আঘাত, শারীরিক কষ্ট ও কাটাছেঁড়া এবং পকেটমারদের এড়ানো একরকম অসম্ভব। কিন্তু সোনা যেভাবে আগুনের স্পর্শে বিশুদ্ধ হয়, তেমনি হাজ্জ্বের সময় দৈহিক, সাংস্কৃতিক এবং মানসিক সংঘর্ষের ভিতর দিয়ে একজন সাধনাকারীর অন্তর বিশুদ্ধতা এবং সমৃদ্ধি লাভ করে। ঘরে বসে থেকে এবং মানুষের ভীড় ও কোলাহল থেকে মুক্ত থেকে একজন ব্যক্তি মাবরুর হাজ্জ্বের উপকারিতা লাভ করার আশা করতে পারে না, কেননা হাজ্জ্ব হচ্ছে মানুষের সাথে সংযোগের ভিতর দিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের সরণী। রাসূলুল্লাহ (সা) নিঃসঙ্গতা অপেক্ষা সামাজিকতার গুরুত্ব অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন: “যে মুমিন জনগণের সাথে সম্পর্ক রাখে এবং ধৈর্য সহকারে তাদের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত লাঞ্ছনা ও আক্রমণ সহ্য করে, সে ঐ মুমিন অপেক্ষা উত্তম যে কিনা যে জনগণের সাথে মেশে না কিংবা তাদের পক্ষ থেকে কোন আঘাত সহ্য করে না।”

যে হাজ্জ্ব আল্লাহর নিকট গৃহীত হয়, হাজ্জ্বকারীর ওপর তার স্থায়ী প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তার ভিতর একপ্রকার গভীর আত্মিক পরিবর্তন আসে যা তার জীবনকে নতুন করে (আল্লাহর আনুগত্যের ভিত্তিতে) সাজানোর মাঝে পরিলক্ষিত হয়। মাবরুর হাজ্জ্বের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সচেতনতার ফলে এই ব্যক্তি সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং আত্মিক পরিবর্তনের সবচেয়ে শক্তিশালী যে হাতিয়ার, সেই ইসলামকে দর্শন হিসেবে গ্রহণ করার এবং জীবনে বাস্তবায়িত করার প্রতি অন্যদেরকে আহ্বান জানাবে। এরকম পরিবর্তন যদি তার মাঝে দেখা না যায় এবং সে যদি হাজ্জ্বের পরেও পূর্বের অনৈতিক জীবনে প্রত্যাবর্তন করে, তবে বুঝতে হবে তার হাজ্জ্ব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কর্তৃক গৃহীত হয়নি। এই হাজ্জ্বের ফলে তার দায়িত্ব আদায় হয়েছে বটে, কিন্তু যে উচ্চতর লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য হাজ্জ্বের আচার অনুষ্ঠানগুলো নির্ধারিত ছিল, সেগুলো অর্জিত হয়নি।

বর্তমান মুসলিম সংস্কৃতিতে হাজ্জ্ব: একজন ব্যক্তি বালেগ হওয়া মাত্রই তার ওপর হাজ্জ্ব বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। মুসলিম সংস্কৃতিতে প্রচলিত যে ধারণা যে বৃদ্ধকাল পর্যন্ত হাজ্জ্বকে বিলম্বিত করা উত্তম – তা সম্পূর্ণ ভুল। রাসূলুল্লাহ (সা) এর একটি হাদীসকে ভুল বোঝার ফলে এই ধারণা তৈরী হয়েছে। তিনি (সা) বলেছেন: “যে আল্লাহর নিকট গ্রহণীয় হয়, এমনিভাবে হাজ্জ্ব আদায় করবে, সে এমনিভাবে পাপমুক্ত হয়ে ঘরে ফিরে আসবে, যেন তার মা ঐদিনই তাকে প্রসব করেছে।” এ থেকে কিছু মানুষ ধারণা করে যে হাজ্জ্বকে এমন বয়স পর্যন্ত বিলম্বিত করা উচিৎ, যখন মানুষের কোন ধরনের পাপকাজ করার সামর্থ্যই থাকে না। অথচ হাজ্জ্বকে এভাবে বিলম্বিত করাটা নিজেই একটা পাপ। তাছাড়া যে এভাবে বার্ধক্য পর্যন্ত পাপকাজ করে যাবে বলে মনে মনে ঠিক করে নেয়, তার হাজ্জ্ব আল্লাহর নিকট কবুল না হওয়ারই কথা। বিলম্বিত এই হাজ্জ্ব সাধারণতঃ খুব নি®প্রাণ ও গদবাঁধা হয়ে থাকে, যাতে একাত্মতা থাকে অনুপস্থিত। ফলে এরূপ ব্যক্তিকে দেখা যায় হাজ্জ্ব থেকে ফিরে এসে গায়ে বিশেষ পোশাক (যেমন টুপি) লাগিয়ে এবং নামের শুরুতে “হাজী” লাগিয়ে সদম্ভে ঘোরাঘুরি করতে। কিন্তু তাদের আভ্যন্তরীণ কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় না, যা কিনা এ কথাই প্রমাণ করে যে আল্লাহ তাদের হাজ্জ্ব গ্রহণ করেননি। তেমনি কিছু লোকের জন্য হাজ্জ্ব বাৎসরিক প্রমোদ-ভ্রমণের মত। তাদের জন্য বিশেষ ভাবে “এক্সপ্রেস” হাজ্জ্বের ব্যবস্থা করা হয়, যেন হাজ্জ্বে ন্যূনতম কষ্ট হয়।

মুসলিম চরিত্রে হাজ্জ্বের কাঙ্খিত প্রভাব:

  • ক. বিশ্বজনীনতা: বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দুই মিলিয়ন মুসলিমের বাৎসরিক এই সম্মেলন মুসলিমদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে দৈহিক ও জৈবিক পার্থক্য মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। সকল মানুষই একই জাতির অন্তর্ভূক্ত: মানবজাতি। একজন স্রষ্টাই সবাইকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের জন্য একটি ধর্মই ঠিক করেছেন। হাজ্জ্ব মুসলিমদের আরও মনে করিয়ে দেয় যে বিশ্বে যে রাজনৈতিক বিভক্তি – যার ফলে জাতিগত-রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে, তা কখনই মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্যবোধকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। যে ধরনের জাতীয়তাবোধ পাকিস্তানবাসীকে পাকিস্তানের ক্রিকেট দল এবং ভারতবাসীকে ভারতীয় ক্রিকেট দলের সমর্থন করতে উদ্বুদ্ধ করে, কিংবা মিশর ও সৌদি-আরবের ফুটবল খেলায় নিজ নিজ দেশের লোকদেরকে দুদলে বিভক্ত করে দেয়, সে ধরনের জাতীয়তাবোধ হাজ্জ্বের মাধ্যমে প্রাপ্ত ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা এবং উম্মাহর প্রতি দায়িত্ববোধের শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত। যদিও দেশপ্রেম থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু এ ধরনের অনুভূতি এমন মাত্রায় হওয়া উচিৎ নয়, যে অবস্থায় মানুষ তার জাতি, গোত্র কিংবা পরিবারকে সমর্থন করে, যদিও তারা ভুল পথে থাকে। জুনদুব (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে উদ্ধৃত করেছেন: “যে অন্ধভাবে গোত্রবাদকে সমর্থনকারী কিংবা গোত্রবাদের দিকে আহবানকারী আন্দোলনে নিহত হয়, সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করে।”
  • খ. ধৈর্যশীলতা: কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে একই আনুষ্ঠানিকতা পালনের উদ্দেশ্যে বহুলোক জড় হলে সেখানে দুর্ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক। একে অপরের পায়ে পাড়া দেয়া কিংবা পাশের ব্যক্তির কনুইয়ের খোঁচায় ব্যথা পাওয়ার মত ঘটনা খুবই স্বাভাবিক। এরূপ অবস্থায় মানুষ সাধারণতঃ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে থাকে। কিন্তু একজন হাজ্জ্বকারীকে তার হাজ্জ্ব কবুল হওয়ার জন্য অন্যদের দেয়া এইসব আঘাত চুপ করে সহ্য করতে হয়, ফলে সে ধৈর্যের শিক্ষা লাভ করে।

No comments:

Post a Comment